সোমবার, ১৮ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

জাতীয় ঐক্য হয়ে গেছে

জঙ্গিবাদের মদদদাতা, অর্থদাতাদের খুঁজে বের করা হবে : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতীয় ঐক্য হয়ে গেছে

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। দেশের যেসব মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলে সত্যিকার অর্থেই জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠবে তাদের ঐক্য গড়ে উঠেছে। গ্রামে গ্রামে কমিটি হচ্ছে। সর্বস্তরের মানুষ সচেতন হয়ে উঠেছে। এবার ঈদের নামাজে সনাতন ধর্মের যুবকরা পাহারা দিয়েছে। এটা বাংলাদেশের জন্য অভূতপূর্ব অর্জন। এই ঐক্য থাকবে। কিন্তু যারা সন্ত্রাসী, জঙ্গি, পেট্রলবোমা হামলাকারী, যুদ্ধাপরাধী তাদের কথা আলাদা। তারা ‘সর্প হইয়া দংশন করে আর ওঝা হয়ে ঝাড়বে’— এটা চলবে না। গতকাল বিকালে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের  জবাবে প্রধানমন্ত্রী এসব বলেন। এশিয়া-ইউরোপ মিটিং (আসেম) সম্মেলন উপলক্ষে ১৪ থেকে ১৬ জুলাই মঙ্গোলিয়া সফর-পরবর্তী এই সংবাদ সম্মেলনে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে যার যার অবস্থান থেকে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ সব সময় সন্ত্রাসবিরোধী, জঙ্গিবাদবিরোধী। দেশের মানুষকে সব সময় এর বিরুদ্ধে সচেতন থাকতে হবে। যারা যার অবস্থানে থেকে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের অর্থদাতা, মদদদাতাদের খুঁজে বের করা হবে। বিএনপির পক্ষ থেকে আলোচনায় বসার আহ্বানের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমার মনেও প্রশ্ন জাগে— তাদের সঙ্গে আলোচনায় না বসলে তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবে, মদদ দিয়ে যাবে? গুলশানে সন্ত্রাসী হামলার তদন্তে অগ্রগতি সম্পর্কে বিদেশি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী  বলেন, সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার তদন্তে তাজ্জব হয়ে যাওয়ার মতো তথ্য আসছে। তবে, তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলা হচ্ছে না। তদন্তের স্বার্থে সবকিছু বলাও হয় না। তবে যে তথ্য আসছে, তাজ্জব হয়ে যাওয়ার মতো। তদন্ত শেষে সবকিছু বুঝতে পারবেন সবাই। আরেকটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আতঙ্ক সৃষ্টি করাই সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্য। কয়েকটি শপিংমলে আক্রমণ হবে এমন খবর এলো। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী সতর্ক হয়েছে, পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরাও জনগণকে সচেতন হতে বলেছি। সন্ত্রাস মোকাবিলায় যা যা করার দরকার আমরা তা করছি। যার যার অবস্থানে থেকেও নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মূল মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন প্রমুখ। সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মর্যাদায় কিছুটা ভাটা পড়েছে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গুলশানের ঘটনা ভিন্ন মাত্রায় হয়েছে। অনেক বিদেশি মারা গেছে। তবে এতে একেবারে সম্মান হারিয়ে ফেলেছি, তা না। এখন সম্মান হারালে সারা বিশ্বই হারাবে, সব জায়গায়ই হামলা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমার কষ্ট লেগেছে এ জন্য যে, আমি এত কষ্ট করে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরেছিলাম। এখন এ ঘটনাটা আমাদের একটা প্রশ্নবোধক চিহ্নে ফেলে দিল। জঙ্গিবাদ এখন কেবল বাংলাদেশের নয়, বৈশ্বিক সমস্যা। এই বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ এখন বিশ্ব সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারও। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ক্ষমতায় আসায় পর পিলখানা বিদ্রোহ হয়েছে। শুধু পিলখানাতেই হয়নি, সে সময় ৪০টি ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছিল। সেটি আমরা নিরসন করেছি। আমরা এগুলো মোকাবিলা করেই এতদূর এসেছি। এতদিন আমরা এগুলো নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলাম। কিন্তু গুলশানের হামলার পর আমাদের সে অবস্থান অনেকটা কমে গিয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা অর্থনীতিতে সক্ষমতা অর্জন করেছি। যখন সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা। বিশ্ব যখন অর্থনীতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে তখন আমাদের অর্থনীতি ছিল সচল। বিশ্বে অর্থনীতিতে মন্দা থাকার পরেও বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, এগুলো (সন্ত্রাসী হামলা) প্রতিরোধে পরিবারগুলোকে সচেতন করতে হবে। মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। ধর্মীয় নেতাদের আহ্বান জানিয়েছি, তারা মানুষের মাঝে জনমত সৃষ্টি করছে, আমাদের শিক্ষকরা সচেতন করছে, মন্ত্রণালয়গুলো তাদের নিয়ে বসছে— এভাবে আমরা কতগুলো পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা এটা খুব ভালোভাবে বিশ্বাস করি, সব শিক্ষক আর সব ছাত্রছাত্রী সন্ত্রাসে জড়িত না। কারও জন্য অন্যের শিক্ষাজীবন নষ্ট হোক, সেটা নিশ্চয়ই আমরা চাই না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি চালু হবে কিনা জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, দেশে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ না, আমরা ছাত্র রাজনীতি করেছি। তবে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নিয়ম থাকে, তারা তাদের নিয়মে চলবে। তবে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। আগে দেখা যেত মাদ্রাসার ছাত্ররা এটা করছে। কিন্তু এখন সমাজের সব সুবিধা যারা পাচ্ছে তারাও বেহেশতের হুর-পরী পাওয়ার লোভে মানুষ খুন করছে। মানুষ খুন করলে বেহেশতের দরজা খোলে না। জঙ্গিদের বিচারে ধীরগতি নিয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, ফাঁসির ২১ জেএমবি আসামির মামলা হাইকোর্টে ঝুলে আছে। তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও হচ্ছে না। বিচারগুলো সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ আরও বোঝামুক্ত হবে। অন্যরাও বুঝতে পারবে জঙ্গিবাদে জড়ালে বা অপকর্ম করলে শাস্তি এমন হবে। গুলশানের হামলাকারীদের পরিচয় নিয়ে পুলিশের তথ্যে বিভ্রান্তি ছিল— পুলিশ কি স্বীকার করতে চায় না, এমন এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সন্ত্রাসীরা একেক জায়গায় একেক নামে ছিল। পত্রিকাতেই এসেছে সন্ত্রাসী নিবরাস ঝিনাইদহে সাঈদ নামে ছিল। কাজেই তারা বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। পুলিশের কাছে যে নামে পরিচিত ছিল তারা সে নামেই তালিকা প্রকাশ করেছে। চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মিতু হত্যার প্রসঙ্গ তুলে এক সাংবাদিক জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, কয়দিন হলো ঘটনার? আর আমার কাছে এমন প্রশ্ন কেন? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। কত বছর পর আমি বিচার পেলাম? তারপরও আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজগুলো করছি। যুদ্ধাপরাধীর বিচার করছি। শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে আসার পর থেকে আমার ওপর অনেকবার হামলা হয়েছে। জীবনে বহুবার হামলার সম্মুখীন হয়েছি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হয়েছে। আমাদের ২২ জন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। ৮৫ কেজি বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল আমাকে মারার জন্য। জিয়াউর রহমানের আমলেও আমাদের মিছিলের ওপর ট্রাক তুলে দেওয়া হয়েছিল। মিতু হত্যাকাণ্ডের কয়দিন হয়েছে? ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই তথ্য পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলছে। তুরস্কের সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারপ্রধান বলেন, আমরা সব সময় অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে। তুরস্কের জনগণ সেনা অভ্যুত্থান মোকাবিলা করে প্রমাণ করে দিয়েছে জনগণই ক্ষমতার উৎস। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যখন আসেম সম্মেলনে তখনই ফ্রান্সে হামলার ঘটনার খবর আসে, তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার খবর আসে। আমি তখনো নিন্দা জানিয়েছি, এখনো নিন্দা জানাচ্ছি। আমরা সব সময় অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ঘটনা কিন্তু অনবরত ঘটে যাচ্ছে। এটা শুধু বাংলাদেশের ঘটনা না, এটা বিশ্বব্যাপী, উন্নত দেশগুলোতেও হচ্ছে। কোথায় কীভাবে হচ্ছে, তথ্য বের করতে হবে। সহযোগিতা সবাইকে সবাই করতে হবে। এটা মোকাবিলার বিষয়ে আসেমে আমরা বলেছি— যে যা তথ্য পাই, আদান-প্রদান করে এর মোকাবিলায় যা যা করার আমরা করব। আমি বলেছি, ‘সন্ত্রাসী হামলার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে আমরা সব ব্যবস্থা নিয়েছি।’ তিনি বলেন, নিশা দেশাই (মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী) যখন এসেছেন, তখনো আমি বলেছি, আমাদের প্রথমে লাগবে ইন্টিলিজেন্স ইরফরমেশন। এটা তাদের শক্তিশালী। এ জন্য আমরা তথ্য চাই— কে করেছে? কেন করেছে? কোত্থেকে এগুলো হচ্ছে? এটা শুধু বাংলাদেশের না, যেখানে যেখানে এগুলো হচ্ছে সবাই মিলিতভাবে এগুলো মোকাবিলা করবে, তথ্য শেয়ার করবে।

সর্বশেষ খবর