সোমবার, ১২ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা
অন্য চোখে

বৃদ্ধের তরুণী ভার্যার বিষবৃক্ষ বৃত্তান্ত

গোলাম মাওলা রনি

বৃদ্ধের তরুণী ভার্যার  বিষবৃক্ষ বৃত্তান্ত

সেবার আফতের মোল্লা যখন শেষবারের মতো বিয়ে করলেন তখন তার বয়স ৮০ বছর। ১৮ বছরের গরিব ঘরের সুন্দরী তরুণী লাইলীকে বিয়ে করে সে এলাকায় রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দিল। ছোট্ট একটি গ্রাম্য বাজারে আফতের মোল্লা জ্বালানি কাঠ অর্থাৎ লাকড়ির ব্যবসা করেন। তার ঘরের সামনের অংশে দোকান আর পেছনটায় বসবাস। বাজারের লোকজন দোকানটির সামনে দিয়ে যায় আর মুচকি মুচকি হাসি দিয়ে খুকখুকে কাশি দেয়। আফতের মোল্লা নির্বিকার থেকে সবার সঙ্গে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করেন। কিন্তু একদিন সকালে বাজারের লোকজন দেখল বৃদ্ধ আফতের মোল্লা রেগে মেগে অস্থির হয়ে লাঠি হাতে তার দোকানের সামনে হম্বিতম্বি শুরু করে দিয়েছেন। লোকজনের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি যা বললেন তা রীতিমতো অশ্রাব্য এবং মুদ্রণের অযোগ্য। লোকজন চলে যেতে যেতে ভাবল বুইড়া পাগল হয়ে গিয়েছেন। আজ এত বছর পর হঠাৎ করেই আফতের মোল্লার কথা মনে এলো মহামতি চাণক্যের একটি বাণীর কথামালা পড়তে গিয়ে। চাণক্য বলেছেন— ‘অভ্যাসহীন বিদ্যা, অজীর্ণ ভোজন এবং বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা বিষতুল্য।’ কথামালাগুলো খুবই সাদামাটা, সাধারণ এবং সহজবোধ্য যা অনাদিকাল থেকে আমাদের সমাজ সংসার ও রাষ্ট্রের সবাই কমবেশি জানেন। অর্থাৎ কোনো বিদ্যা অর্জন করায় যদি নিয়মিত চর্চা করা না হয় তবে তা মনে থাকে না। এ ধরনের অভ্যাসহীন ডিগ্রিধারী বিদ্যার্থীকে যদি তার বিদ্যাসংক্রান্ত কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হঠাৎ করে দেওয়া হয় তবে সেটি তার জন্য বিষতুল্য হয়ে ওঠে। অজীর্ণ ভোজন করার বিপদ সম্পর্কেও সবাই জানেন। বিশেষত যার পেট খারাপ অথবা যিনি নিয়ত বদহজমের দ্বারা আক্রান্ত তার সামনে অমৃত পেশ করা হলেও সেগুলো বিষের মতো প্রতীয়মান হবে। অন্যদিকে, বৃদ্ধ বয়সে তরুণীকে বিয়ে করলে কি কি বিষক্রিয়ায় কত সব বিষবৃক্ষের জন্ম হয় তা কেবল ভুক্তভোগী নয়— পাড়া প্রতিবেশীরাও জানেন। চাণক্যের মর্মবাণী পড়তে গিয়ে মনে হলো— তার মতো সর্বকালের অন্যতম সেরা রাজনীতিবিদ, মহাজ্ঞানী এবং সমর কৌশলবিদ নিশ্চয়ই কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত ছাড়া এমন সাধারণ একটি বাণী রচনা করেননি। তিনি রাজনীতির মানুষ। একেবারে শূন্য অবস্থা থেকে ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম একটি সাম্রাজ্য নির্মাণের প্রধান কারিগর ছিলেন চাণক্য। তিনি ছিলেন স্বভাবজাত পণ্ডিত, দক্ষ সেনাপতি, প্রধান রাজ আমত্য এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী। তার কর্ম প্রচেষ্টায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, বিন্দুসার এবং অশোকের মতো মহামানব ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন। খ্রিস্টের জন্মের তিনশত বছর আগে তার রচিত অর্থশাস্ত্র নামক গ্রন্থটি মানব রচিত পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম সেরা বই হিসেবে স্বীকৃত যা কিনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে সায়েন্স অব পলিটিক্স গ্রন্থ নামে পরিচিত। কাজেই চাণক্যের মতো মহাজ্ঞানী রাজনীতিবিদ কোনো রাজনৈতিক উপলক্ষ এবং ইঙ্গিত ছাড়া কোনো বাণী রচনা করবেন তা মনে করার কোনো কারণ নেই। স্পষ্ট আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাসের সৈন্যরা যখন তাদের সামরিক বিদ্যা ভুলে গিয়ে বিলাস ব্যসনে ব্যস্ত ঠিক তখন চাণক্যের সেনাবাহিনী তাদের ঝটিকা আক্রমণ করে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করেন। সেনাপতি সেলুকাস তার কন্যা নিকাটরকে সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সন্ধি করে সে যাত্রায় প্রাণে রক্ষা পান। অন্যদিকে ভারতের বিখ্যাত নন্দ বংশের শেষ সম্রাট ধনানন্দের বিশাল সৈন্যবাহিনী এবং টইটম্বুর রাজকোষ থাকা সত্ত্বেও অথর্ব বৃদ্ধ রাজ আমত্যদের অকর্মণ্যতার কারণে তিনি সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং চাণক্য বাহিনীর কাছে নির্মমভাবে পরাজিত ও নিহত হন। অযোগ্য আমলা, সেনাপতি এবং মন্ত্রীদের কারণে সম্রাট ধনানন্দের দুই লাখ পদাধিক, ২০ হাজার অশ্বারোহী, তিন হাজার রণহস্তি এবং দুই হাজার যুদ্ধবাহন কোনো কাজেই আসেনি। একজন অজীর্ণের কাছে অমৃত পেশ করা হলে যেরূপ বিষতুল্য মনে হয় তেমনি সম্রাট নন্দের বিশাল সেনাবাহিনী এবং যুদ্ধাস্ত্র তা প্রয়োজনের সময় তার কাছে বিষতুল্য হয়ে উঠেছিল। বাস্তব জীবনের হাজারো প্রতিকূলতা এবং সফলতার সমন্বিত অভিজ্ঞতা থেকেই চাণক্য অনুধাবন করেছিলেন যে, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, কঠোর অনুশাসন এবং নীতি নৈতিকতা ও সুশাসন দ্বারা রাষ্ট্রের সামরিক-বেসামরিক আমলা ও আমত্যদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তা রাষ্ট্র ও রাজার জন্য বিষতুল্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে যুদ্ধের নেতৃত্ব কখনো বৃদ্ধদের দিয়ে যেমন সম্ভব হয় না তেমনি গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক দায়িত্বও তাদের কাছে বিষতুল্য অথবা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারা নিজেদের অন্যের কাছে বিষবৃক্ষ বানিয়ে ফেলেন। রাষ্ট্রে যদি উল্লিখিত দুই শ্রেণির লোকদের আধিক্য থাকে তবে জনগণের করের টাকা পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য বিষতুল্য হয়ে ওঠে। আজ থেকে দুই হাজার তিনশত বছর আগে চাণক্য এসব কথাবার্তা লিখে গিয়েছিলেন। তিনি যদি এখন জীবিত থাকতেন এবং বর্তমান জমানার রাষ্ট্র ব্যবস্থার বাস্তব অবস্থা দেখতেন তবে তার রাজকীয় লিপিকারকে ডেকে বলতেন— ওহে নাগন! নতুন করে লিখে নে— ‘বৃদ্ধের নিকট তরুণী ভার্যা হলো অমৃতের মতো উপাদেয় এবং মধু মিছরি অপেক্ষা সুমিষ্ট। ইহা বৃদ্ধকে বিশেষ চেতনা দান করে। তার ব্যথাবেদনা দূর করে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহকে বলশালী করে তোলে এবং নতুন কুল রক্ষায় মহৌষধ হিসেবে কাজ করে।’

সর্বশেষ খবর