বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

ছাড় দেওয়া যাবে না

শামীম আজাদ

ছাড় দেওয়া যাবে না

যে কোনো আন্দোলন, যুদ্ধ, সংগ্রাম, সাধনা বা অধ্যবসায়ের ফলের অনুসঙ্গেই গোপনে এগিয়ে আসতে থাকে নানান আশঙ্কাও। সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবী ছাড়া অন্যরা জয়ের ধারা ও সমঝোতার উপসর্গ পর্যালোচনা করে তখনই বিজয় আনন্দ উপভোগ করার সময়েই, থিতু হয়ে বসবার আগেই সে সব জানান দিতে থাকেন। যেমন পাকিস্তান হওয়ার সূচনাকালেই রাষ্ট্রভাষা সিদ্ধান্তে রাজনীতিকদের জন্য একটি সংকট প্রশ্ন এগিয়ে আসছে তা নিয়ে লিখেছিলেন সাংবাদিক আবদুল হক, মাহবুব জামাল জাহেদী প্রমুখ। তখন এমন একটি রাষ্ট্র হচ্ছে যেখানে ধর্মীয়ভাবে সামঞ্জস্য থাকলেও ভাষাগত নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ও রাজনৈতিক এলিট নেতাদের ভাষা এক নয়। এক নয় বলেই পাকিস্তান নামে যে ধর্মভিত্তিক নতুন রাষ্ট্র হচ্ছে তার ভাষা বাংলা হওয়া উচিত এবং তা নিয়ে নেতাদের ভাবা উচিত। সে সব আশঙ্কা নিয়েই দেশ হলো এবং সে দেশে জিন্নাগংরা বিজয়ীর আনন্দ উপভোগ করার আগেই পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো তাদের জন্য এক উপদ্রব। যে কোনো লড়াই-ই হোক। বিজয়ের পর পরই কিছু মৌলিক সিদ্ধান্তগুলোতে জনমনের প্রধান প্রধান আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন না থাকলে শাসক শ্রেণির কৌশলে পালটা পিঠেই গজাতে থাকে নিগৃহীতের আন্দোলনের বীজ। তার উত্থানের উৎস। এটাই স্বাভাবিক। এটাই হয়েছিল এবং পাকিস্তান হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যেই হলো ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন যখন দানা বেঁধে উঠছে তখন ১৯৫১ সালে কবি জীবনানন্দ দাশ দেশ পত্রিকায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। পূর্ব বাংলার বরিশালের কবির সে প্রবন্ধের বিষয় ছিল সেই ভূখণ্ডের প্রান্তজনের ভাষা। আশঙ্কাভরা মনে তিনি দুটি দিক তুলে ধরেছিলেন। সে দুটি দিক পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মানুষের বাংলা ভাষা নিয়ে। কারণ দুই ভূখণ্ডে উপভাষা বাংলাই প্রধান ভাষা থাকলেও একটি ক্রমশ হিন্দি এবং অপরটি উর্দু দ্বারা তাড়িত হতে পারে। পশ্চিম বঙ্গের ভারতে তার সে আশঙ্কা অনেক আগেই বাস্তব হয়েছে। আর পূর্ববঙ্গে? এখানে পাকিস্তানই আর থাকেনি। ভাষিক অনুপ্রেরণাই রক্তত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছে সেখানের মানুষকে এবং বাংলাদেশ নামে নতুন এক দেশের জন্ম হয়েছে। তারও হয়ে গেছে পঞ্চাশ বছর। এই সময়ের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের ব্যাপারে দ্বিপক্ষীয় আদান প্রদানে ভারতের অনমনীয় মনভাবের কারণে এখানে বাজার হারিয়ে সেখানেই বরং বাংলা সাহিত্যের প্রসার বেগ পেতে লাগল। যা টিকে থাকল তা বাংলাদেশেরই কারণে। এখানে নানান সাহিত্য সাংস্কৃতিক আয়োজন ও অনুষ্ঠানে ভারতের বাংলা ভাষার কবি সাহিত্যিকদের ব্যাপক আগমন হতেই থাকল। ক্রমে ক্রমে হিন্দি সংস্কৃতি ও ভাষার আগ্রাসন হতেই থাকল— কিন্তু সেখানে বাংলাদেশের টিভি, বই, সিনেমার প্রবেশ হলো না। ফলে যা ঘটেছে তা আমরা সবাই এখন প্রত্যক্ষ করছি। বিশেষ করে বাংলাদেশের বিবাহ অনুষ্ঠান থেকে শাড়ি উঠে গেছে। বাংলা গান উবে গেছে। দ্বিতীয় ভাষা হয়ে উঠেছে হিন্দি। অন্যদিকে যে ধর্মের ধুয়া তুলে পাকিস্তান হয়েছিল, সেই শক্তিই বিশ্ব রাজনীতির সুযোগে আচার আচরণে, শিক্ষা কার্যক্রমে, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে দেশটিকে পেছনে নিয়ে যেতে থাকল। বিশেষ করে ব্যাহত করতে থাকল বাঙালিবোধ কেন্দ্রিক চিন্তাচেতনাকে। ফলে বাংলাভাষা, আমাদের জাতীয় ভাষা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। আইন করে কোনো মোক্ষলাভ হয় না যতক্ষণ না তা প্রয়োগ হচ্ছে। ভাষার ক্ষেত্রে প্রয়োগ ব্যবস্থার আওতায় পড়ে কিছু সংগঠন, প্রচার মাধ্যম, পড়াশোনা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা কারিকুলাম ও তার সহায়তা। এখন বোধকরি সহায়তার ব্যাপারটি এবং সহায়কের নিজস্ব এজেন্ডাই প্রধান হয়ে পড়েছে। এমনকি রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যাপারেও একই কথা। তাই এত বিশাল বাংলাভাষাভাষীর ভাষাতেও বিকৃতি ধরছে। শুধু সতর্কতা নয়, দৃঢ় পদক্ষেপ না নিলে অচিরেই সে আলামত পচন হয়ে গা খুলে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তাই ছাড় দেওয়া চলবে না কিছুতেই। বাংলা ভাষার ওপর নতুন ভাবে— নতুন নতুন কৌশলে, নতুন উদ্যমে, নতুন আর্থিক সহায়তায়, নতুন রাজনীতিতে, নতুন বিভ্রমে, নতুন চাহিদায় অথবা বাংলা ভাষার ওপর প্রাচীন ভাবেই পুরাতন কৌশলে, পুরাতন চেতনায়, পুরাতনদের আর্থিক অনুদানে, পুরাতন রাজনীতির ধজাধারিতায়, পুরাতন ঘোরে, পুরাতন সুবিধাবাদীদের চাহিদায়—সে যাই হোক আমাদের মাতৃভাষার ওপর যে আজ একটা আক্রমণ, আগ্রাসন, আস্ফাালন ঘটছে তা দেখে দরকার হয় না বুঝিয়ে বলার যে, এ আমাদের অস্তিত্বকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে আজও আমাদের হাতিয়ার এ বাংলা ভাষাই। বাংলাদেশের সব মানুষ নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনের অপরাপর মৌলিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারলে তবেই অটুট থাকবে আমাদের অস্তিত্ব। এটাই ছিল বায়ান্নর লড়াই, এটাই হয়েছে একাত্তরের সংগ্রাম, এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।লেখক : প্রবাসী কবি ও শিক্ষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর