শনিবার, ২৩ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

মেসির স্বপ্ন অধরাই রয়ে যাবে?

আসিফ ইকবাল

রেফারির শেষ বাঁশি বাজতেই আকাশপানে চাইলেন লিওনেল মেসি। এরপর বাঁ হাত দিয়ে দুই চোখ মুছলেন। ক্যামেরায় ক্লোজ হয়ে আসা মেসির অবয়বে ফুটে উঠেছিল না পারার কষ্ট, ক্লান্তি আর বেদনার ছাপ। ‘বরফরাজ্য’ আইসল্যান্ডের সঙ্গে ড্রয়ের পরও টিকে ছিল স্বপ্ন। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে স্বপ্নকে ছুড়ে ফেলতে হয়েছে কাস্পিয়ান সাগরে। আন্তে রেবিচ, লুকো মদ্রিক, ইভান রাকিতিচরা চোখ-ধাঁধানো, মন ভোলানো গোল করে এক এক করে পেরেক ঠুকেছেন আর্জেন্টিনার সম্ভাবনার কফিনে। চুরমার করে দিয়েছেন পাঁচবারের বিশ্বসেরা ফুটবলারের বিশ্বকাপ ট্রফি তুলে ধরার স্বপ্নকে। ক্রোয়েশিয়ার কাছে হারের পরও গাণিতিক হিসাবে সূক্ষ্ম একটি সম্ভাবনা রয়ে গেছে মেসিদের। সেজন্য নাইজেরিয়ার হারাতে হবে আইসল্যান্ডকে। এমন জটিল সমীকরণে দাঁড়িয়ে থাকা মেসির বিশ্বকাপ তাহলে কার্যত শেষই বলা যায়! যদিও নাইজেরিয়ার বিপক্ষে একটি ম্যাচ এখনো বাকি আর্জেন্টিনার। তবে এটা ঠিক, আর্জেন্টিনার এই ঝুলে পড়ার আশঙ্কায় বর্ণ হারিয়েছে বিশ্বকাপ। একই সঙ্গে হারিয়েছে সৌন্দর্যও। মেসির বয়স এখন ৩১। চার বছর পর কাতার বিশ্বকাপে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৩৫। ওই বয়সে বিশ্বকাপে খেলার ভাবনা আর ছোট্ট ডিঙিতে উত্তাল আটলান্টিক পাড়ি দেওয়া প্রায় একই। তাই রাশিয়ায় পা দেওয়ার আগে আগে নিজে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলেন টার্গেট, ‘নাউ অর নেভার’, ‘হয় এবার, না হলে আর নয়।’ আইসল্যান্ডের বিপক্ষে নিষ্প্রাণ ড্রয়ের পর ক্রোয়েশিয়ার কাছে হার, দুই ম্যাচের ফল এখনই বলতে পারে বিশ্বকাপ ট্রফি মেসির অধরাই রয়ে গেল।

২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপ থেকে খেলছেন মেসি। এক যুগ আগে যখন প্রথম সুযোগ পেয়েছিলেন তখন তিনি ছিলেন বিস্ময় বালক। ম্যারাডোনার উত্তরসূরি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার বিশাল প্রান্তরও পেয়েছিলেন। আর্জেন্টিনা সেবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে পড়েছিল। তিনটি ম্যাচ খেলে ১টি গোল করলেও আলো ছড়াতে পারেননি মেসি। পরের চার বছর বার্সেলোনায় নিজেকে শানিত করে খেলতে আসেন দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে। ২৩ বছরের মেসি তখন অনেক পরিণত। কিন্তু ক্লাব ফুটবল আর বিশ্বকাপের মঞ্চ যে এক নয়, সেই প্রবচনকে তিনি গুঁড়িয়ে দিতে পারলেন না। দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা সেবারও ছিটকে পড়ল কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। সেবার নিষ্প্রভ মেসি। পাঁচ ম্যাচে গোলের দেখা পেলেন না। শুধু সহায়তা করেছেন একটি; যা তার নামের পাশে বড্ড বেমানান। ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে নিজেকে মেলে ধরলেন। একাই দলকে টেনে নিয়ে যান ফাইনালে। সাত ম্যাচে গোল করলেন ৪টি। কিন্তু আর্জেন্টিনাকে উপহার দিতে পারেননি বিশ্বকাপ ট্রফি। ১৩ জুলাই, ২০১৪ সালে টমাস মুলার, মিরোস্লাভ ক্লোসাদের কাছে হেরে যাওয়ার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরশু রাতে নিঝনি নভগরদে সেই একইভাবে কাঁদলেন মেসি। এবার বিশ্বকাপ না জেতার নয়। বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে ছিটকে পড়ার প্রান্তে চলে আসায় এবং জীবনে আর কখনো বিশ্বকাপ না জেতার জটিল সম্ভাবনায়।

আর্জেন্টিনা এবারই প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে ছিটকে পড়েছে এমন নয়। ১৯৫৮ ও ’৬২ সালে টানা দুই বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড টপকাতে পারেনি। মজার বিষয়, ওই দুই আসরে বিশ্বকাপ ট্রপি জিতেছিল ব্রাজিল। ২০০২ সালেও আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডের বাধা টপকাতে পারেনি। সেবারও ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এবারও কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে?

তারকা হয়েও পারলেন না— বিশ্ব ফুটবলে এমন দুর্ভাগা শুধু মেসিই নন। ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ শুরুর পর বহু তারকা ফুটবলার দুনিয়া মাতিয়েছেন তাদের খেলার সৌকর্য দিয়ে। কিন্তু জিততে পারেননি বিশ্বকাপ। এদের অন্যতম ব্রাজিলের জিকো, যিনি ১৯৮২ সালের সর্বকালের সেরা ব্রাজিল দলের দলের মূল কাণ্ডারি ছিলেন। কিন্তু বিশ্বকাপ জেতা হয়নি। নেদারল্যান্ডসের ইয়োহান ক্রুইফ ১৯৭৪ সালে গোটা বিশ্বকাপে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন টোটাল ফুটবল খেলে। ফাইনালও খেলেছিলেন। কিন্তু জিততে পারেননি বিশ্বকাপ। রবার্তো ব্যাজিও স্মরণীয় হয়ে আছেন বিশ্ব ফুটবলে শুধু ১৯৯৪ সালে ফাইনালে টাইব্রেকারে পেনাল্টি মিস করে। যদি মিস না করতেন, তাহলে তিনিও পেলে, ম্যারাডোনার মতো বিশ্বকাপ ট্রফি আকাশপানে তুলে ধরার আস্বাদ পেতেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়েই শেষ করতে হয়েছে বিশ্বকাপ। ফুটবলশিল্পে গোটা বিশ্ব মোহিত করে রেখেও বিশ্বকাপ জিততে পারেননি ইউসেবিও, জর্জ বেস্ট, ফন ভ্যানবাস্টেন, আলফ্রেড ডি স্টেফানোর মতো ফুটবলার। বিশ্বকাপ জেতেননি বলে এরা হয়ে গেলেন পতিত তারকা, তা কিন্তু নয়। নিজ নিজ ফুটবল সৌন্দর্যে ফুটবল বিশ্বে আলাদা করে জায়গা করে রেখেছেন। বিশ্বকাপ জিততে পারেননি বটে তবে মেসিও আলাদা জায়গা করে ফুটবলকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

সর্বশেষ খবর