মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

নুসরাত হত্যায় ডাকসুর কর্মসূচি নেই, শিক্ষকরা করেন রাজনীতি

নিজস্ব ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক

নুসরাত হত্যায় ডাকসুর কর্মসূচি নেই, শিক্ষকরা করেন রাজনীতি

তোফায়েল আহমেদ

বর্ষীয়ান রাজনীতিক, ডাকসুর সাবেক ভিপি ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্রদের সম্পর্ক যদি ভালো হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ভালো হয়। আমাদের সময়ে শিক্ষক এবং ছাত্রের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের মতো। তখনকার শিক্ষকরা কেউ রাজনীতি করতেন না। তাই প্রত্যেক ছাত্র শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু এখন শিক্ষকরা কেউ করেন বঙ্গবন্ধু পরিষদ, কেউ করেন জিয়া পরিষদ। এখানে উপস্থিত শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা কিন্তু একটা ভাবাপন্ন শিক্ষক, অন্য ভাবাপন্ন শিক্ষক এখানে নেই। তোফায়েল আহমেদ গতকাল বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য ভবনে ডাকসুর সাবেক ও নবনির্বাচিত নেতাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ে ‘ডাকসু ও হল সংসদ অভিজ্ঞতা শুনি সমৃদ্ধ হই’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছিলেন। তোফায়েল আহমেদ ডাকসু ভিপি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র গণ-আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে ইতিহাসে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নায়ক হন। তিনিই লাখো জনতার সংবর্ধনা সভায় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন সেদিনের কারামুক্ত অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। ফেনীর মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার প্রতিবাদে ডাকসুর কোনো কর্মসূচি না থাকায় মর্মাহত জানিয়ে বর্তমান নেতাদের উদ্দেশে ডাকসুর সাবেক ভিপি তোফায়েল আহমেদ বলেন, এখানে ডাকসুর ভিপি, জিএস, এজিএস আছেন। বিভিন্ন হল শাখার ভিপি-জিএস আছেন। ফেনীর শিক্ষার্থী নুসরাত হত্যাকান্ডে র শিকার হলেন। আপনাদের কোনো প্রতিবাদ কর্মসূচি নেই। এটা আমাকে মর্মাহত করেছে, ব্যথিত করেছে, আহত করেছে। সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। রাস্তায় আসতে আসতে একজনকে দেখলাম, নুসরাতের উদ্দেশে চিঠি লিখেছে, ‘নুসরাত তুমি চলে গেছ, তুমি তো চলে যেতে চাওনি।’ এভাবে সুন্দর করে হৃদয়স্পর্শী একটা প্রবন্ধ লিখেছে। আমরা যখন ছাত্রনেতা ছিলাম, তখন আমাদের একটাই দাবি ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যা বলতেন, আমরা তাই করতাম। এখন স্বাধীন বাংলাদেশ, সেই অবস্থা নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্র সমাজকে ভালোবাসেন। তিনি দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, অছাত্র অবস্থায় আমি কোনোদিন হলে থাকিনি। এ জন্য আপনারা যারা কর্তৃপক্ষ আছেন, অছাত্র যাতে হলে থাকতে না পারে, এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিন। আমাদের সময় একটা বিষয় ছিল, হলের সিট নিয়ে মারামারি রক্তারক্তি হতো না। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। বক্তৃতা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক ড. খন্দকার বজলুল হক এবং ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. মুশতাক হোসেন। পরে ডাকসু কর্তৃক নববর্ষের বিশেষ পত্রিকা ‘বছর ত্রিশেক পরে’-এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়। ডাকসু নেতাদের পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচিত ছাত্রনেতাদের সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনারা সব ছাত্রের প্রতিনিধি। আপনারা মধুর ক্যান্টিনে যাবেন, চা খাবেন, কর্মসূচি নিয়ে বিতর্ক হবে। কিন্তু বের হওয়ার সময় হাত ধরাধরি করে বের হবেন। স্মৃতিকাতর হয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমি ভর্তি হয়েছিলাম মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগে। ভর্তি হয়েই আমি তৎকালীন ইকবাল হলের ক্রীড়া সম্পাদক হয়েছিলাম। তারপরের বার ইকবাল হলে জিএস পদে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা করে ছাত্রইউনিয়নের প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছিলাম। এটাই আমার ছাত্রজীবনের প্রথম পরাজয়। আমি পাঁচ ভোটে পরাজিত হই। ছাত্রলীগ থেকে নোয়াখালীর মোহাম্মদ হানিফ ভিপি পদে আর জিএস পদে আমি প্রার্থী ছিলাম। পরবর্তীতে তিনি এমএনএ হয়েছিলেন, আমিও হয়েছিলাম। তিনি বলেন, আমরা হাতে পোস্টার লিখতাম। আমি যখন বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম, তিনি আমাকে দুইশ টাকা দিয়েছিলেন নির্বাচনে খরচের জন্য। আমার মনে আছে, আমাদের ব্যঙ্গ করা হতো। লেখা আছে, ‘হানিফ-তোফায়েল পরিষদ’, পড়ত ‘হানিফের টু তোফায়েল ফেইল পরিষদ।’ পরে আমি আমার মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের পেসিডেন্ট হয়েছিলাম। পরবর্তীতে আমি পূর্ণ প্যানেলে বিজয়ী হয়ে ভিপি হয়েছিলাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাবেক রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমি যখন ভিপি হলাম, তখন জাতির পিতা জেলখানায়। জেল থেকে তিনি আমাকে চিঠি লিখেছিলেন। আমরা শপথ নিয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্ত করব। অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ডাকসু ও হল সংসদ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেউ কারও প্রতিন্দ্বন্দ্বী নয়। বরং পরিপূরক। সবাই মিলে ঐক্য, সংহতির মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে কাজ করতে হবে। এ সময় তিনি ডাকসু নির্বাচনের ধারা অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ছাত্রদের দাবি-দাওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের অনেক বাকবিত া হবে। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে, সরকার আর প্রশাসন এক নয়। আবার অনেক সময় ছাত্রসংগঠনকেও সরকারের সঙ্গে একাট্টা করে ফেলা হয়। তবে সরকারের সঙ্গে যে ভাষায় কথা হয়, শিক্ষকদের সঙ্গে সেই ভাষায় কথা বলা চলবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে ছাত্রশিক্ষক সবাইকেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অধ্যাপক ড. খন্দকার বজলুল হক বলেন, বাংলাদেশ ইতিহাস সৃষ্টির পেছনে ডাকসুর দায় রয়েছে। ডাকসু না থাকলে এর ইতিহাস ভিন্ন রকম হতে পারত। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি এবং পরাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি এক নয়। সে সময়ে নেতারা যা করেছেন, তা হয়তো সে সময়ের জন্য সঠিক ছিল। কিন্তু এখনকার রাজনীতি হবে মানুষের রাজনীতি, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার রাজনীতি।  তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী এখন যেমনটা চাচ্ছেন, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে দেশের চেহারা পাল্টে যেত। ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় দেশের রাজনীতি ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। বজলুল হক বলেন, ছাত্ররা টাকার পিছনে ছুটবেন, গাড়িতে চড়বেন, এটা আমাদের সময় স্বপ্নের মতো ছিল। কিন্তু এখন এটার সুযোগ আছে। ছাত্রনেতাদের ছাত্রের মতো থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধু যেমন ছাত্রনেতা ছিলেন, তেমন ছাত্রনেতা হতে হবে।

সর্বশেষ খবর