রবিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

খুনি হুদার ময়মনসিংহ অপারেশন

বিশেষ প্রতিবেদন

১৯৯০ সাল। দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে। সভা সমাবেশ চলছে দেশজুড়ে। থেমে ছিল না বঙ্গবন্ধু খুনিদের সশস্ত্র দল ফ্রীডম পার্টি। তারাও দেশের বিভিন্ন জেলায় সশস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত। বঙ্গবন্ধুর খুনি ফ্রীডম পার্টির শীর্ষ নেতা বজলুল হুদা ময়মনসিংহে অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। তারা ওই অঞ্চলে তাদের ঘাঁটি তৈরির জন্য নানা পরিকল্পনা আঁটে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ তখন ময়মনসিংহেও। ফেব্রুয়ারিতে বজলুল হুদা ঢাকা থেকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ময়মনসিংহে রওনা হলেন। তার সঙ্গে ছিল লিবিয়া ফেরত ফ্রীডম পার্টির অর্ধশতাধিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্যাডার। এরা প্রত্যেকেই হালকা অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। ১১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ময়মনসিংহ শহরের পুরবী সিনেমা হলের সামনে অবস্থান নেয় তারা। তারা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু ময়মনসিংহের মানুষ বজলুল হুদাকে দেখে চিনে ফেলে। তাদের অনেকেই তখন চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘ওই যে বঙ্গবন্ধুর খুনি বজলুল হুদা।’ এমন চিৎকারে বজলুল হুদার অবস্থানের খবর চাউর হয়ে যায়। লোকজন দলে দলে ছুটে যেতে থাকে পুরবী হলের দিকে। এ সময় ফ্রীডম পার্টির ক্যাডাররা গুলিবর্ষণ করে আর বোমা ছোড়ে। একপর্যায়ে বজলুল হুদা নিজেই এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকেন। ফ্রীডম পার্টির আরেক নেতা মেজর জয়নাল ও আশরাফুল আলমও গুলি চালান। নিরস্ত্র মানুষের ওপর বজলুল হুদা তার সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করলে পুরো শহর জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাদের হাতে একে একে গুলিবিদ্ধ হতে থাকে সাধারণ মানুুষ। এ সময় অন্তত ১০ জন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকে। গুলিবিদ্ধ হারুন জহুর আলী, মাহবুবুল, রামচন্দ্র, শামীম ও লিটনকে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক হারুনকে মৃত ঘোষণা করেন। হারুন স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী ছিলেন।

বজলুল হুদা ও তার বাহিনী গুলি করতে করতে পিছু হটতে থাকে। তারা একপর্যায়ে গাড়িতে উঠে ঢাকার উদ্দেশ্যে পালাতে শুরু করে। বজলুল হুদাসহ ফ্রীডম পার্টির ৩০ নেতা-কর্মীকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশাল ও ভালুকায় পুলিশ আটক করলেও পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

সশস্ত্র ক্যাডাররাই শুধু নয়, অস্ত্র হাতে রাস্তায় নেমে গুলি চালাতেন ফ্রীডম পার্টির ফারুক রশীদ বজলুল হুদারা। তারা নিজেরাই নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন অসংখ্য হামলার। তারা সামনে থেকে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতেন, আর তাদের ক্যাডাররা বৃষ্টির মতো বোমা আর গ্রেনেড ফাটাতেন। এরকম অনেক ঘটনায় সশস্ত্র অবস্থায় দেখা গেছে ফারুক রশীদ বা বজলুল হুদাকে। বজলুল হুদা ও তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্যাডারদের সম্মিলিত হামলা ময়মনসিংহের মানুষ জীবন দিয়ে রুখে দেয়। তবে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ফ্রীডম পার্টির ক্যাডারদের সেই হামলার ঘটনা মনে পড়লে এখনো বুক কাঁপে ময়মনসিংহবাসীর। সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও অন্যন্য সূত্রে জানা গেছে, বজলুল হুদার ভয়ঙ্কর সেই অপারেশনের এসব তথ্য।

ময়মনসিংহের হারুন হত্যার ঘটনায় নিহতের ভগ্নিপতি বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। ওই বছরের ১০ জুলাই বজলুল হুদাকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এরপর সম্পূরক অভিযোগপত্র, তদন্ত এবং হাই কোর্টের আদেশে বিচার স্থগিত থাকায় দীর্ঘ ১৯ বছর এ মামলার বিচার কার্যক্রম আটকে থাকে। ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সিআইডি সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়ার পর জনগুরুত্বপূর্ণ মামলা হিসেবে এটি বিচারের জন্য ময়মনসিংহ আদালত থেকে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এ পাঠানো হয়।

২০১৭ সালের ৯ মে এই মামলায় ২৭ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয় ঢাকার একটি আদালত। ঢাকার ২ নম্বর দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মমতাজ বেগম এ রায় ঘোষণা করেন। দ-িত হলেন- আশরাফুল হক ওরফে আশরাফুল আলম, ওমর ফারুক, লিংকন, জালাল, সৈয়দ শামীম হোসেন, রহিম আহম্মদ, শামছুল ইসলাম, আবুল হোসেন, ফারুক আহম্মেদ, আকবর হোসেন, এরফানুর রহমান খান, সোলায়মান, জাহিদ, সাফায়াত উদ্দিন চৌধুরী, আবদুর রশীদ, গোলাম রব, শিশির চৌধুরী, অ্যাপোলো হোসেন, আসলাম, ইলিয়াস হোসেন, হিরু মোহাম্মদ, লিয়াকত আলী, কাঞ্চন মিয়া, শেখ আশরাফ হোসেন, আনিছুর রহমান, আবু তাহের ও নুরু। আসামিদের মধ্যে আশরাফুল হক ও নূরউদ্দিন জামিনে ছিলেন। আবদুর রশীদ আছেন কারাগারে। বাকিরা পলাতক।

এ মামলার তিন আসামি জীবিত না থাকায় তাদের বিচার বন্ধ রাখা হয়। এদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত মেজর বজলুল হুদার মৃত্যুদ- কার্যকর হয় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায়। সেনাবাহিনীর অপর কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জয়নাল আবেদীন করাগারে অসুস্থ হয়ে মারা যান। আরও একজন আসামি রেজাউল ইসলামও মারা গেছেন।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন যারা : মির্জা মেহেদী তমাল, সাখাওয়াত কাওসার, গোলাম রাব্বানী ও মাহবুব মমতাজী)

সর্বশেষ খবর