বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

৫৪ নদীর পানি বণ্টন ফর্মুলা খুঁজতে ঐকমত্য

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

৫৪ নদীর পানি বণ্টন ফর্মুলা খুঁজতে ঐকমত্য

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন -পিআইডি

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে দক্ষিণ এশিয়ার রোল মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর বলেছেন, অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে একটি ফর্মুলা বের করতে বাংলাদেশ-ভারত রাজি হয়েছে। এ ছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আমলেই তিস্তা চুক্তি হবে বলে দেওয়া প্রতিশ্রুতির বিষয়ে নয়াদিল্লি অনড় বলেও জানিয়েছেন তিনি। গতকাল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।

গতকাল বিকালে গণভবনে এস জয়শঙ্কর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তিনি আগামী অক্টোবরে ভারত সফরের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণপত্র হস্তান্তর করেন। শেখ হাসিনা তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান এবং তাঁর শুভেচ্ছাও মোদির কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বলেন।

দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক শেষে ড. এস জয়শঙ্কর আরও জানান, রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারের রাখাইনে নিরাপদে, দ্রুত এবং টেকসই প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারত একমত হয়েছে। গত বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা জয়শঙ্কর আজ সকালে কাঠমান্ডুর উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করবেন। ভারতের বিজেপি সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটাই প্রথম ঢাকা সফর। গতকাল বেলা ১১টার দিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে জয়শঙ্করের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শুরু হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলা বৈঠকে তিস্তা চুক্তিসহ অমীমাংসিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেন, ‘এটা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আমার প্রথম ঢাকা সফর। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অংশীদারিত্ব প্রতিবেশী দেশগুলোও যে পাশাপাশি একসঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারে তার উদারহণ। আমরা অংশীদার হিসেবে একসঙ্গে কাজ করি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দক্ষিণ এশিয়ায় রোল মডেল হিসেবে এই অংশীদারকে টিকিয়ে রাখতে চান। আমরা বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে গর্ববোধ করি। নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে আমরা বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তার প্রস্তাব দিচ্ছি।’ পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের মন্ত্রী বলেন, পানিসম্পদ বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং আমাদের মতো তারাও অভিন্ন ৫৪টি নদীর জন্য উভয়পক্ষের গ্রহণযোগ্য একটি উপায় বের করতে চায়। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জয়শঙ্কর বলেন, ‘আপনারা জানেন এ ব্যাপারে আমাদের সরকারের একটি অবস্থান আছে। এ ব্যাপারে আমাদের একটি অঙ্গীকার আছে এবং এটা পরিবর্তন হবে না।’ তিনি বলেন, ‘যখন নিরাপত্তার প্রশ্ন সামনে আসে তখন অপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থার বিরুদ্ধে দুই দেশের অংশীদারিত্ব ও উন্নয়ন দুই দেশের জনগণকেই সরাসরি সুফল দেয় বলে আমাদের বিশ্বাস। এখন দুই দেশের জনগণের মধ্যে সবক্ষেত্রে যোগাযোগ বেড়েছে। জনগণের মধ্যে আরও যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। জ্বালানি সহযোগিতার ব্যাপারে তিনি বলেন, দুটি দেশই পরস্পরের সফলতার সুফল ভোগ করে। জয়শঙ্কর বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত সুদৃঢ় এবং ভবিষ্যতে এটা আরও জোরদার হবে। আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী দুটি অনুষ্ঠানই উদযাপন করতে যাচ্ছি। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে নিরাপদ, দ্রুত ও টেকসই প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছি। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার-এই তিন দেশের জাতীয় স্বার্থেই এটা করা জরুরি। বাংলাদেশ থেকে এই বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে এবং রাখাইন রাজ্যের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে আমরা সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছি।’ আসামের নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) হলে ওই তালিকায় থেকে বাদ পড়া লোকজনকে বাংলাদেশে পাঠানোর বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে। এ নিয়ে জানতে চাইলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এটি একান্তভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’ এ সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা হওয়ায় আমরা খুশি। আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। পরে বৈঠকের বিষয়ে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অত্যন্ত উষ্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান সম্পর্কে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তারা গত ফেব্রুয়ারিতে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জেসিসি বৈঠকের নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা করেন। তারা লাইন অব ক্রেডিট এর অধীন বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করেন। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগামী অক্টোবরে ভারত সফরের প্রস্তুতির বিভিন্ন দিক এবং সে সময় দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষর হতে যাওয়া সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি নিয়েও আলোচনা করেন দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এর আগে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাদুঘর পরিদর্শন করেন তিনি।

জাদুঘর পরিদর্শন শেষে ভারতীয় মন্ত্রী যান রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন যমুনায়। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা তাকে স্বাগত জানান। পরে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে জয়শঙ্করের সম্মানে ড. মোমেনের দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন অতিথি মন্ত্রী। পরে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জয়শঙ্কর। রাতে অংশ নেন ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাশের আয়োজনে নৈশভোজে।

প্রধানমন্ত্রীকে ভারত সফরে মোদির আমন্ত্রণ : বাসস জানায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগামী অক্টোবরে ভারতে দ্বিপক্ষীয় সফরের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গতকাল বিকালে গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণপত্র হস্তান্তর করেন।

পরে, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।

ব্রিফিংয়ে প্রেস সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানান এবং তাঁর শুভেচ্ছাও মোদির কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বলেন।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিগত পাঁচ বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক একটি নতুন উচ্চতায় আসীন হয়েছে। তিনি বলেন, এই সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা এবং সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে জয়শঙ্কর বলেন, দুই দেশের জনগণের মধ্যে পরস্পরের দেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রটিকে সহজ করার বিষয়ে বিশ্বাসী ভারত।

জয়শঙ্কর এ সময় বাংলাদেশের জ্বালানি ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে তাঁর দেশের আগ্রহ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে জলবিদ্যুৎ খাতে কার্যকর সহযোগিতার সম্ভাবনা রয়েছে, যেহেতু, এর খরচও কম।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভারত তাঁদের ব্যবসা এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, মোংলা এবং পায়রা বন্দর ব্যবহার করতে পারে।’

দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রগুলো উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, রেল, সড়ক এবং আকাশ পথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেক রুট ইতিমধ্যে উন্মুক্ত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে চমৎকার সহযাগিতা বিদ্যমান রয়েছে। দুটি দেশ নিজেদের অনেক সমস্যাই দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করেছে।

এ প্রসঙ্গে তিনি বিশেষ করে দুই দেশের মধ্যকার সীমান্ত সমস্যা সমাধানের উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, ‘সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী এর সমাধান বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ভারতের সব রাজনৈতিক দল তাদের সংসদে সীমান্ত চুক্তি সংক্রান্ত বিলের প্রতি সর্বসম্মতভাবে সমর্থন জানায়।

ভারতকে বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই নয়াদিল্লি বাংলাদেশের প্রতি অব্যাহতভাবে সমর্থন জানিয়ে আসছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মুয়াজ্জেম আলী, ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাশ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

 

সর্বশেষ খবর