বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

কী হচ্ছে খালেদার মুক্তি নিয়ে

বিদেশ যেতে উচ্চ আদালতে জামিন আবেদন । আছে আইনের মারপ্যাঁচ । পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে সরকার ও বিএনপি

নিজস্ব প্রতিবেদক

কী হচ্ছে খালেদার মুক্তি নিয়ে

কারাবন্দী অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি দেশজুড়েই এখন আলোচনার শীর্ষে। কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ফোনালাপের পরই নতুন করে আলোচনা শুরু। প্যারোল, জামিন না অন্য কোনো উপায়ে বেগম জিয়ার মুক্তি- এ নিয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক। এরই মধ্যে গতকাল ফোনালাপ নিয়ে দুই পক্ষের বিপরীতমুখী অবস্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার মুক্তি নিয়ে নতুন করে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। প্যারোল নিয়ে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কোনো কথা হয়নি বলে জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল। তবে ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, তার সঙ্গে ফখরুলের কথা বলার রেকর্ড তার কাছে রয়েছে। বিএনপি বরাবরই খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তির পক্ষে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে কোনো আবেদন পাওয়া গেলে তারা বিবেচনায় নেবেন। তবে আদালতের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ নয়। গতকাল চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যের মতো দেশে যেতে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জামিন চেয়ে আবারও আবেদন করেছেন খালেদা জিয়া। বিষয়টি নিয়ে বিএনপির পাশাপাশি সরকারও সতর্ক পর্যবেক্ষণে রয়েছে। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, বেগম জিয়ার জামিনে মুক্তির বিষয়টি জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। বিকল্প আরও দুটি পথ খোলা আছে। একটি হলো প্যারোলের আবেদন। অন্যটি রাষ্ট্রপতির কাছে সাজা মওকুফ চাওয়া। তবে দলের নীতিনির্ধারকরা জামিনে মুক্তির পক্ষেই। এমনকি খোদ বেগম জিয়াও সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে বার্তা দিয়েছেন, তিনি জামিনে মুক্তি চান। তিনি মনে করেন, জামিন তাঁর হক। সাংবিধানিকভাবে এটা তাঁর প্রাপ্য। তাঁর এমন কঠোর অবস্থানের কারণে পরিবারের পক্ষ থেকে প্যারোল বা অন্য কোনো আবেদন করা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে।

খালেদা জিয়ার মুক্তি বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কারাগারে থাকা অবস্থায় কারও অসুখ হলে প্যারোলের আবেদন করতে পারেন। তবে তাঁর (খালেদা জিয়া) বিষয়ে আবেদন পাওয়ার পরই এ আলোচনা করা সম্ভব হবে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে খালেদা জিয়া জামিন পাচ্ছেন না। তার পরও আমরা শেষ পর্যন্ত জামিন আবেদন করে যাব। পাশাপাশি রাজপথের আন্দোলনও চলবে।

প্যারোল-সংক্রান্ত সর্বশেষ নীতিমালায় বলা আছে, ভিআইপি বা অন্যসব শ্রেণির কয়েদি বা হাজতি বন্দীর নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর কারণ ছাড়াও কোনো আদালতের আদেশ কিংবা সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্ত মোতাবেক ‘প্যারোলে মুক্তি’ দেওয়ার প্রয়োজন হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যাবে। তবে উভয় ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও দূরত্ব বিবেচনায় প্যারোল মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ সময় নির্ধারণ করে দেবেন। এ ছাড়া মুক্তির সময়সীমা কোনো অবস্থাতেই ১২ ঘণ্টার অধিক হবে না তবে বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার মুক্তির সময়সীমা হ্রাস বা বৃদ্ধি করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে। সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানান, বিএনপি নেতারা দলটির চেয়ারপারসনের মুক্তি চান কিনা তা নিয়ে সরকারের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ, দলটির শীর্ষ নেতারা একেক সময় একেক ধরনের কথা বলছেন। খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে আসলে তারা নতুন করে রাজনীতি করছেন কিনা তাও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্যারোলে মুক্তি নিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশ গেলে সরকারের কোনো আপত্তি থাকবে না। কিন্তু প্যারোল নিয়ে রাজনীতি করার কোনো সুযোগ দেবে না সরকার। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, খালেদা জিয়ার প্যারোলের জন্য আবেদন না করায় তাঁর মুক্তির ক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত কারণগুলো বিবেচনার অবকাশ নেই। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির চেয়ে তাঁর দল ও পরিবার রাজনৈতিক ফায়দা তোলায় বেশি নজর দিচ্ছে। বিএনপিসূত্র জানান, বেগম জিয়ার মুক্তিতে জামিন আবেদনের পাশাপাশি রাজপথের আন্দোলনকেই বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। বেগম জিয়ার ইচ্ছা অনুযায়ী জামিনেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখা হবে। বিএনপি মনে করে, বিষয়টি রাজনৈতিক। তাই রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান হওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বেগম জিয়ার মুক্তি দাবিতে আমরা আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি রাজপথেও থাকব। আমরা মনে করি, বিষয়টি রাজনৈতিক। তাই রাজনৈতিকভাবেই তার সমাধান হওয়া উচিত। সরকার যদি উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ না করে তাহলে বেগম জিয়ার জামিন পেতে আইনি প্রক্রিয়াও কোনো বাধা হবে না।

আইনি মারপ্যাঁচে খালেদার মুক্তি : কারাবন্দী খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি কিছুটা আইনি জটিলতায় পড়েছে বলে মনে করেন তাঁর আইনজীবীরাও। খালেদা জিয়ার আইনজীবী প্যানেলসূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, প্যারোলে মুক্তি পেতে হলে নির্দিষ্ট সময় ও অনেক শর্ত মানতে হবে। আবার রাষ্ট্রপতির কাছে সাজা মওকুফের আবেদন করতে হলে দোষ স্বীকার করতে হবে, যা তিনি (খালেদা জিয়া) করবেন না। তাই এসব বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না কেউই। এ কারণেই প্যারোল বা সাজা মওকুফের কোনো আবেদনই করা সম্ভব হয়নি। সূত্র আরও জানান, জামিনে মুক্তির প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ জেনেও এসব কারণেই আবারও জামিন আবেদনই করা হয়েছে। এদিকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আপিল আবেদন করার পর এত দিনেও তা শুনানির উদ্যোগ না নেওয়ায় নানা প্রশ্ন উঠেছে।

খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, যে দুটি মামলায় এখন তিনি জামিনের অপেক্ষায় আছেন, সে দুটি মামলায় বহু আগেই জামিন হওয়া উচিত ছিল। অথচ আমরা আপিল বিভাগে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি। এখন ম্যাডাম যে অবস্থায় আছেন, যদি দ্রুত উন্নত চিকিৎসা করা না হয় তাহলে ম্যাডামের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তিনি বলেন, আইনের মাধ্যমে তাঁর জামিন পাওয়াটাও সময়সাপেক্ষ। আমি মনে করি, রাজনৈতিক চিন্তার ঊর্ধ্বে, ম্যাডামকে বাঁচানোর জন্য তাঁর উন্নত চিকিৎসা দরকার। আমি আগেও প্যারোলের বিষয়ে মত দিয়েছিলাম। এখনো আমার মতামত প্যারোল আবেদনের দিকেই। দীর্ঘ চিকিৎসায়ও যেহেতু ম্যাডামের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না, তাই তাঁকে নিজ ইচ্ছায় দেশে-বিদেশে চিকিৎসা করার সুযোগ দেওয়া জরুরি বলেও মনে করেন এই আইনজীবী।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইনিভাবে কোনো আসামিকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাব। এর আগেও খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন হাই কোর্ট ও আপিল বিভাগে খারিজ হয়েছিল। আশা করছি, এবারও তাই হবে।

চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে জামিন চান খালেদা জিয়া : চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যের মতো দেশে যেতে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জামিন চেয়ে আবেদন করেছেন খালেদা জিয়া। গতকাল হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ মামলায় ফের জামিন আবেদন করলেন তাঁর আইনজীবীরা। জামিন আবেদনের পর খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন উল্লেখ করে তাঁকে বিদেশে, তথা যুক্তরাজ্যের মতো দেশে নেওয়ার প্রয়োজন বলে জামিন আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আবেদনটি আজ বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চে শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হবে বলেও তিনি জানান। এর আগে ১২ ডিসেম্বর এ মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করেছিল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। এবার খালেদা জিয়ার জামিন হবে- এমন প্রত্যাশা জানিয়ে আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, আপনারা জানেন, প্রায় দুই মাস ধরে আমরা অপেক্ষা করেছি। আপিল বিভাগ উন্নত চিকিৎসার যে আদেশ দিয়েছে, সরকার তা কতটা তামিল করে সেটা আমরা দেখছি। তিনি বলেন, আমরা বেগম জিয়ার আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে জানতে পারলাম, তাঁর আগের যে অবস্থা ছিল তার থেকে অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে তাঁর ডায়াবেটিস এখন ১৪, ১৫-এর নিচে নামছে না। তাঁর ডান হাত বাঁকা ছিল, এখন বাঁ হাতও বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এখন তিনি বসতেও পারেন না, খেতেও পারেন না- এমন অবস্থা। তাই আমরা আমাদের নীতিনির্ধারণী ফোরাম একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিষয়টি নিয়ে আবার কোর্টে যাব।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর