বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

লেখকদের শব্দ তৈরি করতে হবে

নাসরিন জাহান

লেখকদের শব্দ তৈরি করতে হবে

লিখতে গেলে আগে পড়তে হবে। নিজে জানতে হবে। ভালো ভালো বই পড়া ছাড়া ভালো লেখা অসম্ভব। এখন অনেকেই যা লেখেন তাই দিয়েই বই বের করে ফেলেন। সেই বই পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে কষ্ট পান। তরুণ লেখকদের উদ্দেশে আমি বলব, বই বের করার আগে বেশি বেশি লিখুন, ছাপানোর জন্য পত্র-পত্রিকায় পাঠান, যে সব বন্ধুরা ভালো লেখেন তাদেরকে পড়তে দিন, এরপর সব লেখা থেকে বাছাই করে বই বের করুন। তাহলে আর স্বপ্নভঙ্গ হবে না।

একজন লেখক চাইলে ছন্দ ভেঙে গদ্যে লিখতে পারেন। তার আগে তিনটা ছন্দ তাকে জানতে হবে। ছন্দ জেনে ছন্দ ভাঙতে হবে। গানে যেমন সা-রে-গা-মা লাগে। কবিতায়ও তাই। তিনটা ছন্দ, সুন্দর সুন্দর শব্দাবলি, নিজে কিছু শব্দ তৈরি করা। আমি প্রচুর শব্দ তৈরি করি যেগুলো ডিকশনারিতে নেই। আবার ডিকশনারি ঘেঁটে ঘেঁটে বানান পরীক্ষা করতে গেলেও অনেক সুন্দর শব্দ মাথায় গেঁথে যায়। ওইগুলো পরে অনায়াসে লেখার মধ্যে ঢুকে যায়। অন্যান্য লেখকদের লেখা পড়লেও নিজের লেখায় একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই যে কোনো লেখকের প্রচুর ভালো বই পড়া উচিত। ভালো লিখতে চাইলে এর বিকল্প নেই।

লেখার ক্ষেত্রে আড্ডাও অনেক প্রেরণা দেয়। ভালো লেখার উপাদান যোগায়। আগে লেখকদের আড্ডা হতো। আজিজ সুপার মার্কেট, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদ- এসব জায়গায় আমরা আড্ডা দিতাম। ফুচকা-চটপটি খেতাম। আমরা নয়জন প্রতি সপ্তাহে যে গল্প-কবিতা লিখতাম, সপ্তাহের একদিন তা পাঠ হতো। নয়জনের মধ্যে যার লেখাটির কথা বেশিরভাগ মানুষ ভালো বলত সেটাই শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত হতো। তখন একটা প্রতিযোগিতা কাজ করত। এক সপ্তাহে নিজের লেখা ভালো না হলে পরের সপ্তাহে আরও ভালো লেখার চেষ্টা করতাম। এই আড্ডা এখন কমে গেছে। জায়গাও নেই। এ ছাড়া এখনকার আড্ডার মধ্যে সাহিত্যের জায়গা কম। এখন আড্ডায় আজে বাজে শব্দ ব্যবহার, হৈ-হুল্লোড়, একে অন্যের বদনাম- এগুলোই বেশি। আশির দশকে এটা ছিল না। কারও পিছনে কেউ বদনাম করতাম না। শুদ্ধ আড্ডা হলে সাহিত্যের সমৃদ্ধি ঘটত। এখন সবাই একে অন্যের পিঠ চাপড়ায়। যার সঙ্গে যার ভালো সম্পর্ক সে তার নাম বলে। অথচ, আমরা এ ব্যাপারে খুবই আপসহীন ছিলাম। হাজার কষ্ট পাক মুখের ওপর ভালো-মন্দ বলে দিতাম। রূপকথার মতো একটা সময় পেয়েছি। অবশ্য জীবনানন্দ দাশের মতো কিছু কিছু নিভৃতচারী মানুষও আছে যারা নিজের মতো করে লেখেন এবং ভালো লেখেন। তবে এমন মানুষের সংখ্যা কম।

তরুণদের উদ্দেশে বলব, বই বের করার আগে লিখে পত্র-পত্রিকায় পাঠান। আমরা তো প্রচুর পাঠিয়েছি। অনেক লেখা ছাপা হয়নি। তখন কেঁদেছি পর্যন্ত। বই বের করার কথা মাথায়ই আসেনি। আমি মনে করি, যতক্ষণ লেখা পত্রিকায় ছাপার উপযুক্ত না হচ্ছে, ততক্ষণ তা বইয়ের উপযুক্ত হবে না। একসময় আমার লেখা পত্রিকায় ছাপা হতে শুরু করল। একটা লেখা ছাপা হলে খুশিতে চোখে পানি চলে আসত। লেখার পাশাপাশি নিজেকে সমৃদ্ধ করতে শুরু করলাম। প্রচুর ভালো ভালো বই পড়তে শুরু করলাম। প্রায় সব জাতীয় পত্রিকায় যখন আমার লেখা ছাপা হয়ে গেল, তখন পাঠকমহলে একটা পরিচিতি পেয়ে গেলাম। প্রথম গল্পের বইটা যখন বের করি তখন আমার ২৫টির মতো গল্প ছিল। সেখান থেকে বাছাই করে ছয়টি গল্প দিয়ে বই করি। এখন তো অনেকে যা লিখছেন তাই দিয়েই বই বের করে ফেলছেন। এতে নিজের লেখার মান ওই লেখক বুঝতে পারছেন না। নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারছেন না।

লেখক : কথাসাহিত্যিক। অনুলেখক : শামীম আহমেদ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর