শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় বিপর্যস্ত শিক্ষা খাত

আকতারুজ্জামান ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

করোনায় বিপর্যস্ত শিক্ষা খাত

মহামারী করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে প্রায় ছয় মাস ধরে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরাসরি পাঠদান দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় বিপর্যস্ত শিক্ষা খাত। প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীই ক্ষতিগ্রস্ত করোনার ছোবলে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে টেলিভিশনে পাঠদান চালু থাকলেও বর্তমানে শিক্ষার্থীরা এ ক্লাসে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর এখন এ ক্লাসে মনোযোগ নেই। একাদশের শিক্ষার্থীদের কলেজে ভর্তি বিলম্বের পাশাপাশি পিছিয়ে গেছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাও। করোনার কারণে এ বছর বাতিল হয়েছে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণির জেএসসি, জেডিসি পরীক্ষা।

এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সুযোগ নেই। এ সময় টেলিভিশন, রেডিও, সোশ্যাল মিডিয়াসহ নানা মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের যে সুবিধা তা এসব মাধ্যমে হচ্ছে না। এতে বড় ধরনের শিখন দক্ষতায়

শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে একটি প্রকল্প তৈরি করেছি। প্রকল্পটি বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ২ হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তারা একটি ওয়ার্কপ্ল্যান তৈরি করে দেশের ৬৪ হাজার ৬২০টি স্কুলে প্রয়োগ করবেন। এ প্রকল্পে অর্থায়ন করবে গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশন। প্রকল্পের আওতায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন কনটেন্ট তৈরি করে শিক্ষার্থীদের জন্য টেকসইভাবে সংরক্ষণ করা হবে।’

শিক্ষা বছরের মাত্র আড়াই মাসের মাথায় করোনার কারণে ১৭ মার্চ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। এতে হোঁচট খেয়েছে সকল পর্যায়ের শিক্ষার্থী। এরপর করোনার কারণে দফায় দফায় বাড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটিও। ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের যত ক্ষতি : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে ৩০-৩৫ শতাংশ ক্লাস শেষ হয়েছে। করোনার এই সময়ে প্রাথমিকের বিভিন্ন শ্রেণির জন্য সংশোধিত লেসন প্ল্যান তৈরি করেছে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি-নেপ। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী অক্টোবরে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সরকার স্কুল খুলে দিলে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্লাস চলবে। এরপর পরীক্ষা বা মূল্যায়ন করা হবে শিক্ষার্থীদের। এ ছাড়া নভেম্বরে স্কুল খোলা গেলে ৪০ দিন পাঠদান করে মূল্যায়ন করা হবে। আর করোনার কারণে যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না যায় সে ক্ষেত্রে পরীক্ষা বা মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে না। তখন পরবর্তী ক্লাসে প্রমোশন দেওয়া হবে।

এপ্রিলে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের সাময়িক পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও তা বন্ধ হয়ে গেছে। নভেম্বরে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষা নির্ধারিত থাকলেও করোনার কারণে চলতি বছরে এ দুই পরীক্ষা বাতিল করেছে সরকার। সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করে এসব পরীক্ষা নিজ নিজ স্কুলে নিতে বলেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। করোনার সময় প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের (প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত) সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের মাধ্যমে পাঠদান চালু রেখেছে সরকার। তবে দিনাজপুরের বিরামপুরে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়–য়া শিশু শিক্ষার্থীর মা আনিছা খাতুন জানান, শিশুদের জন্য টেলিভিশনের ক্লাস কোনো কাজেই আসছে না। টেলিভিশনের সামনে শিশুদের বসে পাঠ গ্রহণ করা অসম্ভব।

মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরাও বিপাকে : অষ্টম শ্রেণিতে কেন্দ্রীয়ভাবে সারা দেশে জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। কিন্তু করোনার কারণে পাঠদান বন্ধ থাকায় এ বছর এ দুই কেন্দ্রীয় পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। কীভাবে এ শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বা মূল্যায়ন করা হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে জানায়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিকে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে পাঠদান করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে টেলিভিশনে পাঠদান চালু থাকলেও বর্তমানে শিক্ষার্থীরা এ ক্লাসে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রী এখন এ ক্লাসে মনোযোগী নয়। মাধ্যমিকের বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সাময়িক পরীক্ষা এপ্রিলে হওয়ার কথা থাকলেও তা নেওয়া সম্ভব হয়নি।

কী হবে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের : প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে টেলিভিশনের মাধ্যমে ক্লাসের আয়োজন করা হলেও একাদশ ও দ্বাদশের শিক্ষার্থীদের জন্য এমন কোনো আয়োজনই রাখেনি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতর। বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো কলেজ এ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অনলাইন ক্লাসের আয়োজন করলেও সিংহভাগই এ ক্লাসের বাইরে থেকে গেছেন। এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারিত ছিল ১ এপ্রিল থেকে। করোনার প্রভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণার পর এ শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ইতোমধ্যে পাঁচ মাস পিছিয়ে গেছে। কবে, কীভাবে এদের পরীক্ষা নেওয়া হবে সে বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরপরই সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন শুরু হয়। এইচএসসি পরীক্ষা আটকে যাওয়ায় এ শিক্ষার্থীরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নিয়েও। এ ছাড়া করোনার কারণে এ বছর পিছিয়ে গেছে একাদশের ভর্তি কার্যক্রম। প্রতি বছর ১ জুলাই কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ক্লাস শুরু হলেও এ বছর এখনো ভর্তি কার্যক্রমই শেষ করতে পারেনি শিক্ষা বোর্ডগুলো।

সেশনজটের চিন্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা : দেশের সিংহভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস চলমান থাকলেও বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পাঠদান চলছে না। সে হিসেবে উচ্চবিদ্যাপীঠে অধ্যয়নরত বৃহদাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের বাইরে থেকে যাচ্ছেন। করোনাকালে সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়ার দাবিতে গত বৃহস্পতিবার রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’রা মানববন্ধন করেছেন।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন শিক্ষার্থীদের বড় ক্ষতি থেকে বাঁচাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শহীদ আল বোখারী মহাজাতক ৪ সেপ্টেম্বর বান্দরবানের লামায় দাফন স্বেচ্ছাসেবীদের এক সমাবেশে বলেন, ‘শিশুদের জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে স্কুল। শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও সৃজনশীলতা চর্চার সর্বোত্তম ক্ষেত্র হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাই আমরা শুরু থেকেই বলেছি সারা পৃথিবীতে শিশু মনস্তত্ত্ব নিয়ে যারা কাজ করছেন, বর্তমানে তারাও একই কথা বলছেন যে স্কুলগুলো খুলে দেওয়া হোক। তাতে শিশুরা রক্ষা পাবে সম্ভাব্য অনেক বড় ক্ষতি থেকে।’

এদিকে প্রতি বছর সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হলেও এবার কবে নাগাদ শুরু হবে তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে মন্ত্রণালয় সময় বুঝে ব্যবস্থা নেবে।’

সর্বশেষ খবর