শনিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

শরীরের রং কালো করেও রক্ষা পায়নি খুনি

মির্জা মেহেদী তমাল

শরীরের রং কালো করেও রক্ষা পায়নি খুনি

মাসুদের একটাই কাজ। রোদের মধ্যে শুয়ে থাকা। কখনো সকালে, কখনো ভরদুপুরে। রুটিন করে রোদের মধ্যেই শুয়ে থাকেন তিনি। তার টার্গেট, শরীরের রং কালো করতে হবে। টার্গেট পূরণে দিনের পর দিন বাড়ির উঠোনে খালি গায়ে তিনি রোদের মধ্যে শুয়ে থাকেন। ফর্সা শরীর কালো হয়েছে কি না তা বোঝার জন্য কিছুদিন পর পরই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখেন। সন্তুষ্ট হতে পারেন না মাসুদ। আবারো শুরু হয় শরীর কালো করার যুদ্ধ। এভাবে দেড় মাস পর আয়নায় নিজেকে ভিন্ন এক মাসুদকে খুঁজে পান। মুখ ভর্তি দাড়ি গোঁফ। রোদে পুড়ে শরীর বেশ তামাটে হয়েছে। যার রং কালো বলা হয়। শরীরের রং পাল্টে বেশ সন্তুষ্ট মাসুদ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে মাসুদ বলতে থাকেন, আমাকে ধরা এত সহজ নয়। ছিলাম আমি ফর্সা আর ক্লিন সেভ। সেই আমি এখন কালো রঙের একজন মানুষ। টার্গেট পূরণ হওয়ায় ভীষণ খুশি মাসুদ। তিনি ভাবেন, কঠিন এই কাজটি যখন করতে পেরেছেন, পরবর্তী সব কাজই খুব সহজেই শেষ করতে পারবেন। এমন কথা তার আত্মীয়স্বজনদের কারও কারও কাছে বেশ দাম্ভিকতা নিয়ে বলেছিলেন মাসুদ। বলেছিলেন, আমার  টিকিটিও পুলিশ ছুঁতে পারবে না। নিজেকে পাল্টে ফেলার আনন্দে আত্মহারা মাসুদ। কিন্তু মাসুদ জানে না পুলিশ ও গোয়েন্দারা তাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ও সূক্ষ্ম বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে ভয়ঙ্কর আর ধূূর্ত অপরাধীকে পরাজিত করে। তেমনি মাসুদও রক্ষা পাননি। পুলিশের কাছে তাকে ধরা পড়তেই হয়েছিল।

ঘটনাটি দুই বছর আগের। ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ রাজধানীর কদমতলী থানা এলাকার ধনিয়ায় একটি ভাড়া বাসায় গৃহবধূ শারমিনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার গলায় কালো দাগের চিহ্ন। ঘটনার পর থেকে তার স্বামী মাসুদ পলাতক। স্ত্রীকে গলা টিপে হত্যার পর মাসুদ লাপাত্তা। পরদিন শারমিনের ভাই বাদী হয়ে কদমতলী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। কদমতলী থানার এসআই মো. লালবুর রহমান এই হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে তদন্ত শুরু করেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, তদন্ত প্রতিবেদন ও বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এ খুনের আদ্যোপান্ত। খুনের তদন্তের শুরুতেই পুলিশ টার্গেট করে শারমিনের পলাতক স্বামী মাসুদকে। তাকে গ্রেফতারের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকে। সোর্স নিয়োগ করা হয়। কিন্তু কারও কাছেই কোনো সুখবর নেই। সম্ভাব্য কোনো স্থানেই মাসুদের খোঁজ পাওয়া যায় না। পুলিশ তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে তার অবস্থান জানার চেষ্টা করে। কিন্তু মাসুদের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তাতেও ব্যর্থ হয় পুলিশ। তদন্ত কর্মকর্তা এবার মাসুদের আত্মীয়স্বজনের ওপর নজরদারি শুরু করে। এমন একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তির সন্ধান পেয়ে যায়, যার সঙ্গে মাসুদের ফোনে যোগাযোগ আছে। পুলিশ তাকে আটক করে মাসুদের নতুন মোবাইল নম্বর নেয়। ওই নম্বর ট্র্যাক করার চেষ্টা করে। এ অবস্থায় মাসুদকে গ্রেফতারের খুব কাছাকাছি চলে গেছে বলে পুলিশ ধারণা করেছিল। কিন্তু কোনোভাবেই মাসুদের অবস্থান শনাক্ত করা যাচ্ছে না। কয়েকদিন এভাবে যাওয়ার পর মোবাইলে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আসামির অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা নিশ্চিত হতে পারেন তদন্ত কর্মকর্তা। পুলিশ জানতে পারে, শারমিনের স্বামী মাসুদ পুরাতন প্যান্ট-শার্টের ব্যবসা করতেন। স্ত্রীকে খুনের আগেই এ ব্যবসার জন্য তিনি শনির আখড়ায় দোকানের পজিশনও নিয়েছেন। কিন্তু খুনের পর তিনি আর দোকান করতে চাননি। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে তদন্ত কর্মকর্তা জানতে পারেন, দোকানের পজিশনের টাকা ফেরত নিতে দোকানের মালিক পক্ষের লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন মাসুদ। দোকানের অগ্রিম টাকা ফেরত নিতে ডেমরা এলাকার মিন্টু চত্বরে অবস্থান করছিলেন মাসুদ। এমন তথ্য পেয়ে পুলিশ হানা দিলেও তার খোঁজ আর পায়নি। রীতিমতো তাকে গ্রেফতার করাটা পুলিশের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছিল। পুলিশ তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় দোকান মালিক পক্ষের লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। হত্যাকান্ডের বিষয় তাদের জানিয়ে পুলিশকে সহায়তা করার অনুরোধ করে। তারা রাজি হয়। ১৯ মে বেলা ২টার দিকে মাসুদ আসবে মিন্টু চত্বরে দোকানের অ্যাডভান্সের টাকা ফেরত নিতে। মালিক পক্ষের লোক পুলিশকে সংবাদ দেয়। সংবাদ পাওয়া মাত্রই মামলার আইও এসআই লালবুর ও এএসআই মো. জসিম ঘটনাস্থলে দ্রুত ছুটে যান। কিন্তু দোকানের মালিক পক্ষের লোকজন পুলিশকে সতর্ক করে দেন। তারা বলেন, মাসুদ ধূর্ত প্রকৃতির লোক। ভালো পোশাক ও চালচলনের কাউকে দেখলেই দ্রুত সটকে পড়েন তিনি। তার এমন অভ্যাস বেশ কিছুদিন ধরে খেয়াল করেছেন মালিক পক্ষের লোকজন। পুলিশ এসব তথ্য পেয়ে তাদের অভিযানের পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনে।

কাঁধে বেলচা। পরনে লুঙ্গি আর পায়ে ছেঁড়া স্যান্ডেল। রাজমিস্ত্রির এমন ছদ্মবেশ নিয়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা মিন্টু চত্বরে ঠায় দাঁড়িয়ে। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল মহল্লায় কাজের সন্ধানে এসেছেন। কিন্তু তাদের নজর খুনি ধূর্ত মাসুদের দিকে। অপেক্ষার একপর্যায়ে চলে আসে সেই মোক্ষম সময়। এসআই লালবুর চোখে পড়ে প্রথম। দূর থেকে এক লোক মুখে মাস্ক পরা অবস্থায় দোকান মালিক পক্ষের লোককে সালাম দিচ্ছেন। কিছু মুহূর্ত পরই মাসুদ একদম মালিক পক্ষের লোকজনের সামনে এসে হাজির। পাশেই দাঁড়ানো ছদ্মবেশী দুই পুলিশ কর্মকর্তা। তারা দেরি করেননি। জাপটে ধরে ফেলে মাসুদকে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন মাসুদ। কিন্তু পারেননি। এরই মধ্যে ভিড় জমায় উৎসুক লোকজনও। অনেকেই আবার না বুঝে আসামির পক্ষ নেওয়ারও চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশের তৎপরতা আর দোকান মালিক পক্ষের লোকজনের সহায়তায় উটকো কোনো ঝামেলা হয়নি। স্থানীয়রাও প্রশংসা করেন পুলিশ কর্মকর্তার এই উদ্যোগের।

গ্রেফতার মাসুদ পুলিশের কাছে সব ঘটনা স্বীকার করে নেন। তিনি জানান, পুলিশের নজর এড়াতে নিজেকে পাল্টানোর পরিকল্পনা আঁটেন। এ জন্য তিনি তার চেহারায় পরিবর্তন এনেছেন। চেহারা পরিবর্তন করতে তিনি দিনের বেশিরভাগ সময় রোদে থাকতেন। যাতে করে ফর্সা রং পুড়ে কালো হয়ে যায়। সেই সঙ্গে মুখে রেখেছিলেন বড় দাড়ি-গোঁফ, যাতে করে পুলিশ বা অন্য কেউ তাকে চিনতে না পারেন।

 

সর্বশেষ খবর