সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ায় বাংলাদেশের সামনে নতুন কতগুলো চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে রপ্তানির বাজারে আমরা ডিউটি ফ্রি ও কোটা ফ্রি সুবিধা হারাব। কিন্তু নতুন রপ্তানির বাজারে আবার নতুন সুযোগও সৃষ্টি হবে। সেগুলো কাজে লাগাতে হবে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় রপ্তানিতে ধস নামার আশঙ্কা নেই।’
গতকাল ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরমে কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি আয়োজিত বাংলাদেশের উন্নয়শীল দেশে উত্তরণ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজারে এখনো আমরা শুল্ক দিয়ে পণ্য প্রবেশ করাই। তার পরও অনেক দেশেই আমরা ভালো করছি। ফলে এসব চ্যালেঞ্জ আমাদের আগেও ছিল। গত এক দশকে বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন, প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয়, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। কৃষি খাতেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। যার ফলে আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিপুল সম্ভাবনাও রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে বাংলাদেশ প্রথমবার জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। এরপর দ্বিতীয়বারের পর্যবেক্ষণেও বেশ সন্তোষজনক অগ্রগতি অর্জন করেছে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১২টিসহ আমাদের পাশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ অর্র্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বেশ দ্রুত এগিয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব সুবিধা পায় সেগুলো এখন বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু নতুন সম্ভাবনা হলো বাই লেটারাল ইস্যুতে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কম শুল্কে রপ্তানির বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। ফলে রপ্তানি খাতে ধস নামার কোনো আশঙ্কা নেই। এতে উদ্বিগ্ন হওয়ারও কোনো কারণ নেই।’ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বৈদেশিক ঋণের সুদহার বাড়লেও বাংলাদেশ বড় কোনো ধাক্কার মুখে পড়বে না। তবে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও মেধাস্বত্ব সম্পদ খাতে আমাদের কিছুটা ধাক্কা খেতে হতে পারে। এখানে অবশ্য ওষুধশিল্প খাতে সামান্য ধাক্কা আসতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় সুবিধাগুলোতে আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি। কিন্তু এগুলো কাজে লাগাতে হবে। যেমন বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু বিনিয়োগ ধরার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়তে পারে। সেখানেও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আরেকটা বিষয় হলো, বেসরকারি খাতের সুদের হারেও কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। যার ফলে এ খাতে আমাদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।’অনুষ্ঠানের প্যানেলিস্ট হিসেবে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৩ ডলার। ’৭২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৯৪ মার্কিন ডলারে। এখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মাথাপিছু আয় কমে যায় ৩০ ডলার। তখন কিন্তু আমরা ছিলাম চরম এক বিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে। সে সময় আমাদের সব রাস্তাঘাট ছিল অচল। চট্টগ্রাম বন্দরও ছিল বন্ধ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল। তখন সবাই বলেছিল এ দেশের ভবিষ্যৎ হবে খুবই কঠিন। বৈদেশিক নির্ভরতাই থাকবে আজীবন। কিন্তু এখন জাতীয় আয়ের মাত্র দেড় শতাংশ আসে বৈদেশিক সহায়তা বা ঋণ থেকে। ফলে আমরা আসলেই অনেক দূর এগিয়েছি। আমরা দেশের ব্যক্তি খাতকে অগ্রাধিকার দিতে পেরেছি। এ ব্যক্তি খাতই আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশে কোনো অর্জনকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আমাদের এখন ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসি করতে হবে। ভিয়েতনাম যদি পারে আমরা কেন পারব না! আমরাও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ফ্রি ট্রেড করতে পারব এবং তা করতে হবে। আমরা কেন পিছিয়ে থাকব। আমাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগও আসবে। আবার তা চলেও যেতে পারে। আজ ভিয়েতনামের রপ্তানি ২৬০ বিলিয়ন ডলার। আর আমরা আছি ৪০ বিলিয়ন ডলারে। অথচ ১৯৭১ সালে আমরা একই অবস্থানে ছিলাম। নানা কারণে আমরা এ অবস্থা থেকে বেরোতে বারবার সময়সীমা বাড়িয়েছি। এবার আর পেছানোর সুযোগ নেই। দরিদ্র জাতি হিসেবে আর না থেকে উন্নয়নশীল জাতি হিসেবে যে পরিচিতি এসেছে তাকে প্রমাণ করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এলডিসির ছাপটা মুছে ফেলতে হবে। আমরা যে কোনো বাজারেই ঢুকতে পারব। আমাদের অভ্যন্তরীণ দক্ষতা বাড়াতে পারলে অবশ্যই আমরা আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে বিশ্বদরবারে সম্মানের সঙ্গে চলতে পারব।’
আরেক প্যানেলিস্ট সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের আগে ভাবতে হবে এর অভিঘাতগুলো কী কী হবে। সেগুলো আমরা কীভাবে মোকাবিলা করব। আমরা যদি সঠিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারি তাহলে নিশ্চয়ই আমরা ভালো করতে পারব। এখানে মনে রাখতে হবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণটা যেন টেকসই হয়। যেন আবার পিছিয়ে যেতে না হয়। আমরা যখন সামনে যাচ্ছি তখন সামনেই যেতে হবে। এ জন্য আমাদের বাজার সুুবিধায় একটা অভিঘাত আসবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা প্রভাব পড়বে। আমাদের বিভিন্ন নীতিমালার মধ্যে একটা প্রভাব পড়বে।’
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন এস এম আরিফুজ্জামান। সভাপতিত্ব করেন কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফাউন্ডার চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ শারাফত। আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান শিবলী রুবায়েতুল ইসলাম, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. শেখ মামুন খালেদ প্রমুখ।