সোমবার, ২১ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

অভূতপূর্ব অনিশ্চয়তার মুখে জীবন-জীবিকা

মানিক মুনতাসির

অভূতপূর্ব অনিশ্চয়তার মুখে জীবন-জীবিকা

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেছেন, এক অভূতপূর্ব অনিশ্চিত সময়ের মধ্যে মানুষের জীবন ও জীবিকা। এ মহামারী জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির যতটা ক্ষতি করেছে, তা ইতিহাসে অতুলনীয়। সব ক্ষেত্রের অর্জন পিছিয়ে দিয়েছে। ১৯৯২ সালের পর এই প্রথম নতুন করে দারিদ্র্য বেড়েছে। প্রথম ধাক্কায় দিন আনে দিন খায় তথা এক দিন আয় না করলে সংসার চালানো দায়- এমন মানুষ তাদের যৎকিঞ্চিৎ সঞ্চয় ভেঙে অথবা আত্মীয়স্বজনের সহায়তা নিয়ে অথবা জমি বিক্রি বা বন্ধক রেখে সংসার চালিয়েছিল। এখন তো সঞ্চয় নেই। এখন কোথায় ধার পাবে? আগের ঋণই কীভাবে শোধ হবে? স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিগত খরচ বাড়ছেই। অধিকাংশ মানুষ অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তায় জীবন-যাপন  করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় সম্প্রসারণশীল নীতির দিকে ঝুঁকছে। অথচ চলতি বছর বাংলাদেশে রাজস্ব ব্যয় আরও সংকুচিত হয়েছে। ঘোষিত ঋণভিত্তিক প্রণোদনা প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতির কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পৌঁছাতে পারেনি। অধিকাংশ মানুষের কর্ম নিয়োজনকারী খাতসমূহ বঞ্চিত থেকে গেছে। প্রণোদনা প্যাকেজের বেশির ভাগই গেছে রপ্তানিমুখী আর বৃহৎ কিছু শিল্পের হাতে। অন্যদিকে অনানুষ্ঠানিক খাত, কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত (সিএমএসএমই) আর কৃষি খাত উপেক্ষিত রয়ে গেছে। ফলে বৈষম্য বাড়ছে। পুনরুদ্ধারের গতিপথ ইংরেজি ‘কে’ অক্ষরের চেহারা ধারণ করছে। অর্থাৎ একদিকে সম্পদ কিছু মানুষের হাতে যাচ্ছে, অন্যদিকে অধিকাংশ মানুষের আয় কমছে। মধ্যবর্তী শ্রেণিসমূহের একটি অংশ ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়ছে এবং দরিদ্রের কাতারে চলে যাচ্ছে। কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে দুটি দিক রয়েছে। কর্মসংস্থান ধরে রাখা এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। অধিকাংশ মানুষের কর্মজোগানদারি কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে (সিএমএসএমই) পূর্বে ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা বাজেটে নেই। সামগ্রিক চাহিদা বাড়াতে কারবারে অর্থ ও ঋণ সহায়তা দিলেই পুনরুদ্ধার হবে না। কর্মসংস্থানমুখী ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিনিয়োগ থেকে নতুন কর্মসংস্থান আসবে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ এক দশক ধরে ২৩ শতাংশের কাছাকাছিতে আটকে রয়েছে। বিনিয়োগ স্থবিরতায় করোনার আগেও কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি চলছিল। বিবিএস বলছে, করোনার প্রথম চার মাসেই বেকারত্ব বেড়েছে ১০ গুণ। আইএলও এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের যৌথ প্রতিবেদন বলছে, করোনার কারণে যুব বেকারত্বের হার ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২০২০ সালে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। কাজ হারানো ও নতুন কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, মূলত অভিবাসী আয় জারি থাকায় এবং কৃষকের উৎপাদন চালু থাকায় অধিক হারে অধোগতি থেকে বাঁচা গেছে। তারাই অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে বড় ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু প্রতি মাসে যে পরিমাণ শ্রমিক অভিবাসী হিসেবে যেত, তা এখন থমকে আছে। বিদেশে কর্মী যাওয়া কমছে ৭১ শতাংশ। এভাবে চলতে থাকলে অভিবাসী আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আগামী বছর ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির টার্গেট কতটা যৌক্তিক সে প্রসঙ্গে রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা মূল বিষয় নয়। মূল হলো কীভাবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠন করা যায়। মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং যে কোনো ঝুঁকি মোকাবিলায় মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে হবে দুটো ইউনিট- খানা বা গৃহস্থালি এবং কারবার বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। অভিঘাত মোকাবিলার জন্য প্রতিটি খানায় সরাসরি নগদ অর্থ পৌঁছাতে হবে। সর্বোপরি সর্বজনীন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে যে কোনো অভিঘাতে মানুষের ঝুঁকি প্রশমনের সক্ষমতা বাড়ে। দ্বিতীয়ত, নীতি-কৌশল ও বরাদ্দে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিয়োজিত খাতগুলোতে অধিক প্রাধান্য দিতে হবে। কুটির, ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে সহায়তা বাড়াতে হবে। বাজেট ঘাটতি ও বাজেট বাস্তবায়ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, বাজেট ঘাটতি মূল বিষয় নয়। প্রথমত দেখতে হবে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠন হচ্ছে কি না তা। দ্বিতীয়ত কেন বাজেট ঘাটতি তৈরি করা হচ্ছে। বেতন-ভাতায় ব্যয় করার জন্য বাজেট ঘাটতি বাড়া কাম্য নয়। বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির সামগ্রিক চাহিদা বাড়াতে ব্যক্তি পর্যায়ে ভোগব্যয় বজায় রাখতে এবং ব্যবসায়ে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ধরে রাখতে নগদ অর্থ সরবরাহ করা হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে গড়ে মোট দেশজ উৎপাদনের ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ প্রণোদনাসহ অন্যান্য মাধ্যমে অর্থ সরবরাহ করা হয়েছে। এসব কার্যক্রমে রাজস্ব ও মুদ্রানীতি উভয়কেই ব্যবহার করা হয়েছে। মানুষের হাতে নগদ অর্থ যেতে হবে। কারবারে অর্থ পৌঁছাতে হবে। উৎপাদনশীল খাতে অর্থ পৌঁছানোর মাধ্যমে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান তৈরি হলে বাজেট ঘাটতি সমস্যা নয়।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিনিয়োগের ভালো-মন্দ দিক বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আসলে সুনির্দিষ্ট কৌশলের দরকার রয়েছে। এ কৌশলের প্রথম অংশ হিসেবে ‘সভরেন ক্যাপিটাল ফান্ড’ গঠন করে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, পার্শ্ববর্তী উন্নয়নশীল দেশে চাহিদা আছে। কোনো দেশকে ঋণ দেওয়ার জন্য ‘এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এভাবে যা আয় হবে তা দেশের পুনর্জীবনচক্রভিত্তিক সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ব্যবস্থার জন্য ব্যয় করতে হবে। সর্বজনীন পেনশন ভাতা, বেকার ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, শিশু প্রতিপালন ভাতা, আবাসন সুবিধা, আয় সহায়ক ভাতা ও স্বাস্থ্য ভাতা- এ সাতটি খাতে এ কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে। দেশের ব্যাংকিং খাত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনার আগেই ব্যাংক খাত খেলাপি ঋণে ধুঁকছিল। খেলাপি ঋণের উচ্চহার বিদ্যমান। গত তিন মাসে ব্যাংকের খেলাপি বেড়ে প্রায় ৬ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা হয়েছে। খেলাপি ঋণের ভারে বেসরকারি ব্যাংকগুলো নুয়ে পড়ছে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে মার্চ শেষে এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর চেয়ে বেশি হয়েছে। তিন মাসের ব্যবধানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা এবং সরকারি ব্যাংকগুলোতে বেড়েছে ৩ হাজার ৮৯ কোটি টাকা।

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগ বিষয়ে তিনি বলেন, এখনো সবার জন্য টিকা পাওয়া অনিশ্চিত। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, ‘মোট ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার আওতায় আনার জন্য ভাগ ভাগ করে পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগণকে টিকা দেওয়া হবে এবং প্রতি মাসে ২৫ লাখ করে টিকা দেওয়া হবে।’ এভাবে দিতে গেলে চার বছর লাগবে। চার বছর অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে কাটাতে হবে! সবার জন্য টিকার ব্যবস্থা করতে প্রয়োজন ছিল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, কৌশল ও বাস্তবায়ন ব্যবস্থা। টিকা বহুমাত্রিক উৎস থেকে সংগ্রহ এবং নিজস্ব উৎপাদন দুই ব্যবস্থাই রাখা দরকার ছিল। কিন্তু প্রথমদিকে তা না করে টিকা সংগ্রহে একক নির্ভরতার কারণে বর্তমান সংকট তৈরি হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, বাজেট বাস্তবায়নের হার আগের চেয়ে কম। ২০২১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত সরকার বাজেট বাস্তবায়ন করতে পেরেছে মাত্র ৪৪ শতাংশ। এপ্রিল পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার মাত্র ৪৯ শতাংশের মতো। ১১ মাসে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন বরাদ্দের মাত্র ৩১ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে একেবারে তলানিতে। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি ও কৌশল নির্ধারণে কোনো ধরনের পথনির্দেশ নেই। এমনকি করোনা মহামারীর মতো বিশেষ পরিস্থিতিতে কীভাবে বাজেট বাস্তবায়িত হবে তা নিয়েও কোনো কৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। অর্থবছরের প্রথমদিকে উন্নয়ন বরাদ্দ ব্যয়ের ধীরগতি এবং শেষ দিকের হঠাৎ বেড়ে যাওয়া প্রশ্ন উদ্রেক করে। প্রতিবছর সংশোধিত বাজেটের আকার ছোট হলেও বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের (এডিপি) বরাদ্দকৃত অর্থের আকারে খুব বেশি হেরফের হয় না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর