সোমবার, ৫ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

বিটুমিনে করবৈষম্য নিরসনে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ উপেক্ষিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিটুমিনে করবৈষম্য নিরসনে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ উপেক্ষিত

দেশীয় বিটুমিন শিল্পের সুরক্ষায় কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে আরোপিত ২৬ শতাংশ থেকে শুল্ক-কর হার কমিয়ে আনা এবং পরিশোধিত বিটুমিন আমদানিতে শুল্ক হার বাড়াতে বলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। সংস্থাটি ড্রামে আমদানি হওয়া বিটুমিনে ৪৭ শতাংশ শুল্ক ও বাল্কে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে বলেছে। তবে এ মতামত তোয়াক্কা করছেন না জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। উল্টো তারা নিম্নমানের ভেজাল বিটুমিন আমদানিকে উৎসাহিত করছেন। ফলে সরকারি ও বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকেও নজিরবিহীন শুল্ক-কর বৈষম্যের চড়া মাশুল দিতে হচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) চেয়ারম্যান মুনশী শাহাবুদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্থানীয় বিটুমিন শিল্প সুরক্ষায় আমরা নীতিসহায়তা-সংক্রান্ত সুপারিশ করেছি। এটা এনবিআরকে বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশের আশপাশের কোনো দেশে বিটুমিন উৎপাদিত হয় না। আবার আমদানির বিটুমিনের মান ভালো না। কিন্তু দেশীয় বিটুমিনের মান অনেক ভালো এবং স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও সম্ভব। বিপুল বিনিয়োগে গড়ে ওঠা এই বিটুমিনশিল্পকে সুরক্ষা না দিলে মুখ থুবড়ে পড়বে। উদ্যোক্তারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন।’

জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিটুমিনশিল্পকে নীতিসহায়তা দিতে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে মতামত ও সুপারিশ পাঠানো হয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর)। এর সঙ্গে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) থেকে পাওয়া একটি প্রতিবেদনও সংযুক্তি হিসেবে এনবিআরকে দেওয়া হয়েছে। এর আগে বিটিটিসি তাদের প্রতিবেদনের অনুলিপি দেয় এনবিআরকে।

এনবিআর চেয়ারম্যানকে দেওয়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (অবা-১ শাখা) মোহাম্মদ মনির হোসেন হাওলাদার স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত পত্রে বলা হয়, স্থানীয় বিটুমিন উৎপাদন শিল্প সুরক্ষা ও দেশীয় অবকাঠামোতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত গুণগত মানসম্পন্ন বিটুমিনের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে ড্রামে আমদানি হওয়া ২৭১৩.২০.১০ এইচএস কোডের বিটুমিনে প্রতি ব্যারেলের ট্যারিফ ভ্যালু ৭০ মার্কিন ডলার নির্ধারণপূর্বক ১৫ শতাংশ সিডি, ১০ শতাংশ আরডি, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ এটি ও ২ শতাংশ এআইটি মিলিয়ে মোট ৪৭ শতাংশ আরোপ করা হোক। একই সঙ্গে বাল্ক হিসেবে আমদানি হওয়া ২৭১৩.২০.৯০ এইচএস কোডের বিটুমিনে প্রতি ব্যারেলের ট্যারিফ ভ্যালু ৬২ মার্কিন ডলার নির্ধারণপূর্বক ১০ শতাংশ সিডি, ৫ শতাংশ আরডি, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ এটি ও ২ শতাংশ এআইটি মিলিয়ে মোট ৩৭ শতাংশ আরোপ করতে বলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘আমরা দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় নীতিসহায়তা চেয়ে এনবিআরকে সুপারিশ করেছি। এখন এনবিআরের উচিত হবে বিষয়টি বিবেচনা করে দেখার।’

এর আগে বিটিটিসির সহকারী প্রধান মো. মাহমুদুল হাসান স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে বলা হয়, এত দিন স্থানীয়ভাবে বিটুমিন উৎপাদনকারী কারখানা না থাকায় বিটুমিনাস ক্রুডের চেয়ে পরিশোধিত বিটুমিনের আমদানি শুল্ক কম রাখা হয় দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের স্বার্থে। এখন গুণগত মানসম্পন্ন বিটুমিন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হওয়ায় এ শিল্পের সুরক্ষা বিবেচনায় শুল্ক কাঠামো স্থানীয় শিল্পবান্ধব করে পুনরায় কর নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

প্রতিবেদন বলা হয়, ড্রামে আমদানি করা বিটুমিনে ৪৭ শতাংশ শুল্ক এবং বাল্কে আমদানি করা বিটুমিনের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়। কারণ আমদানি করা বিটুমিনের দাম স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিটুমিনের চেয়ে কম। ফলে স্থানীয় এ শিল্পকে যেন ক্ষতির মুখে পড়তে না হয় সে কারণে আমদানি করা বিটুমিনের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের কথা উঠেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ সড়ক গবেষণাগারে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিটুমিনের গুণগত মান ও বাজার থেকে সংগ্রহ করা আমদানি করা বিটুমিনের মান পরীক্ষা করা হয়। এতে আমদানি করে আনা বিটুমিনের চেয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিটুমিনের মান ভালো বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

জানা গেছে, বিটুমিনাস ক্রুড থেকে বিটুমিন উৎপাদিত হয়। কাঁচামাল আমদানির ওপর মোট ২৬ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। বাংলাদেশে বিটুমিনের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে সড়ক নির্মাণ, বিমানবন্দরের রানওয়ে নির্মাণসহ ফুটপাথ তৈরির কাজে। এ ছাড়া ট্যাংকের ভিতরে প্রলেপে, নৌকার তলদেশে প্রলেপে, ভারী শিল্পে গার্ডওয়াল নির্মাণকাজে, বিদ্যুৎরোধক হিসেবে, ইন্সুলেটিং টেপ, জলরোধী কাপড়, বার্নিশ, অয়েল পেইন্ট, বরার ইন্যামলের বিকল্প ও কোল্ডস্টোরেজ, ইলেকট্রনিক ব্যাটারি, রেফ্রিজারেটর ইত্যাদি তৈরির কাজে বিটুমিন ব্যবহার করা হয়।

বিটুমিন দুটি গ্রেডে উৎপাদন করা হয়, ৮০ বা ১০০ ও ৬০ বা ৭০ গ্রেড। আমদানি হয় বাল্কে ও ড্রামে।

জানা গেছে, বিটুমিন উৎপাদনে প্রধান কাঁচামাল পেট্রোলিয়াম অয়েলস অ্যান্ড অয়েলস অবটেইন্ড মিনারেলস, ক্রুড। যার এইচএস কোড ২৭০৯.০০.০০। এই কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কর বা সিডি ৫ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, আগাম কর বা এটি ৪ শতাংশ এবং অগ্রিম আয়কর বা এআইটি ২ শতাংশ। এই কর কাঠামো পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৫ শতাংশ সিডিসহ মোট আমদানি শুল্ক দাঁড়িয়েছে ২৬ শতাংশ। এ ছাড়া প্রতি ব্যারেলের ট্যারিফ মূল্য ৪০ ডলার নির্ধারিত আছে।

অন্যদিকে দেশে এইচএস কোড ২৭১৩.২০.১০ এবং ২৭১৩.২০.৯০ এর মাধ্যমে ফিনিশড বা তৈরি বিটুমিন আমদানি হয়ে থাকে। ড্রামে বিটুমিন আমদানিতে প্রতি টনের শুল্ক কর নির্ধারিত আছে ৪ হাজার ৫০০ টাকা। এর সঙ্গে অগ্রিম আয়কর বা এআইটি ২ শতাংশ এবং আগাম কর বা এটি ৫ শতাংশ। অন্যদিকে বিটুমিন নামে যদি কেউ বাল্ক আকারে আমদানি করে, সে ক্ষেত্রে প্রতি টনে ৩ হাজার ৫০০ টাকা আমদানি শুল্ক নির্ধারিত রয়েছে। এর সঙ্গে এআইটি ২ শতাংশ এবং এটি ৫ শতাংশ প্রযোজ্য হয়।

দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী ও কর-বিশ্লেষকদের মতে, সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের অন্যতম উপকরণ দেশীয় বিটুমিন উৎপাদনে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত করহার নির্ধারণ অন্যায়, অযৌক্তিক ও অন্যায্য। আমদানিতে বিশাল ছাড় দিয়ে নজিরবিহীন করবৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ধরনের রাজস্বনীতি দেশীয় শিল্পের স্বার্থবিরোধী, সরকারের শিল্প সুরক্ষা নীতির পরিপন্থী। এতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিওর নিয়মনীতি ভঙ্গ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রীতিনীতিবিরুদ্ধ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, বিপুল বিনিয়োগে গড়ে ওঠা দেশীয় বিটুমিনশিল্পে উৎপাদন পর্যায়ে অযৌক্তিকভাবে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত কর বিদ্যমান থাকলেও আমদানিতে অনেক কম। বিটুমিন উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিতে অন্যায্যভাবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বিদ্যমান। অথচ পরিশোধিত বিটুমিন আমদানিতে ভ্যাট নেই। আমদানির বিটুমিন সরবরাহ পর্যায়ে যেখানে ভ্যাট মাত্র ৫ শতাংশ, সেখানে দেশীয় উৎপাদকের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাটের খড়গ রয়েছে। বিটুমিন উৎপাদনে প্রতি টনের কাঁচামাল আমদানিতে খরচ ৫৭০ মার্কিন ডলার হলেও আমদানিতে তা ২৬০ ডলার। এই বৈষম্যমূলক কর কাঠামো বাতিল করে দেশীয় শিল্প সুরক্ষার দাবি উঠেছে। ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, অগ্রিম আয়কর বা এআইটি দিয়ে ব্যবসার পরিচালন খরচ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট বা এটিভি আগে ছিল বাণিজ্যিক আমদানিতে। এখন কাঁচামাল আমদানিতে আগাম কর বা এটি আরোপ করা হয়েছে, এটা প্রত্যাহার করা উচিত। তাদের মতে, যেখানে তৈরি পণ্য আমদানিতে ভ্যাট নেই, সেখানে উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট অযৌক্তিক ও অন্যায়। দেশীয় বিটুমিন সরবরাহ পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাটও অপ্রত্যাশিত।

ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সহসভাপতি এম এ মোমেন বলেন, স্থানীয়ভাবে বিটুমিন উৎপাদনে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত কর আরোপ দেশীয় শিল্প খাতের প্রতি চরম অন্যায়, অন্যায্য ও অযৌক্তিক। যে কোনো স্থানীয় শিল্পের মূলধনী কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ৫ শতাংশের বেশি হতে পারে না। দেশীয় শিল্প মালিকরা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছেন। সংকট উত্তরণে বিটুমিন উৎপাদন পর্যায়ে কর কমাতে হবে।

সর্বশেষ খবর