বৃহস্পতিবার, ৮ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

এক দিনে মৃত্যুর সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০১ জন

করোনা শনাক্ত ১১ হাজার ১৬২

নিজস্ব প্রতিবেদক

এক দিনে মৃত্যুর সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০১ জন

করোনাভাইরাসে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যু। মৃত্যুর মিছিলে এক দিনেই যুক্ত হলো ২০১ জনের নাম। মহামারীর ১৬ মাসে এক দিনে এত মৃত্যু আর কখনো দেখতে হয়নি। যা করোনার ইতিহাসে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এদিকে মৃতদের মধ্যে ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে ১১৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ১১ হাজার ১৬২ জনের। ঢাকা বিভাগেই গত এক দিনে ৪ হাজার ৭৩২ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা দিনের মোট শনাক্তের ৪২ শতাংশের বেশি। খুলনা বিভাগে এক দিনে শনাক্ত রোগী বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৯০০, চট্টগ্রামেও দেড় হাজারের ওপরে। যে ২০১ জন গত এক দিনে মারা গেছেন, তাদের ৬৬ জনই ছিলেন খুলনা বিভাগের বাসিন্দা। ঢাকা বিভাগে মৃত্যু হয়েছে ৫৮ জনের।

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, বুধবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৩৭ হাজার নমুনা পরীক্ষা করে আরও ১১ হাজার ১৬২ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে             ৯ লাখ ৭৭ হাজার ৫৬৮ জনে। তাদের মধ্যে মোট ১৫ হাজার ৫৯৩ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এ ভাইরাস। গত এক দিনে আরও ৫ হাজার ৯৮৭ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ৮ লাখ ৫০ হাজার ৫০২ জন। দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা গত ২৭ জুন থেকেই ১০০-এর ওপরে ছিল। ৪ জুলাই প্রথমবারের মতো মৃত্যুর সংখ্যা ১৫০ ছাড়ানোর খবর আসে। তিন দিনের মাথায় তা এক লাফে ২০০ ছাড়িয়ে গেল। করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনের সামাজিক বিস্তার ঘটায় কভিড এখন ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম পর্যায়ে; হাসপাতালে এখন যে রোগীরা আসছেন, তাদের অর্ধেকই গ্রামের। এ অবস্থায় বেশি সংক্রমণের জেলা ও উপজেলাগুলোতে হাসপাতালে চাপ বেড়েছে। শয্যা খালি না থাকায় যশোর সদর হাসপাতালে বারান্দায় ভ্যানের ওপর কভিড রোগীদের চিকিৎসা দিতে দেখা গেছে বুধবার। করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনের ব্যাপক বিস্তারের মধ্যে এপ্রিলের রেকর্ড ভেঙে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৮ হাজার ছাড়ায় গত ২৮ জুন। এরপর ১ জুলাই থেকে সারা দেশে লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি হয়। এর মধ্যেই মঙ্গলবার রেকর্ড ১১ হাজার ৫২৫ জন রোগী শনাক্তের খবর আসে। তার পরদিন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমলেও এখনো তা ১১ হাজারের ওপরে রয়েছে। আগের দিনের মতোই পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্ত রোগীর হার রয়েছে ৩১ শতাংশের ওপরে, যেমনটা গত বছরের আগস্টে ছিল। বিভাগওয়ারি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত এক দিনে খুলনা বিভাগে যে ৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের ১২ জন যশোর এবং ১২ জন খুলনা জেলার বাসিন্দা ছিলেন। আর ঢাকা বিভাগে মারা যাওয়া ৫৮ জনের মধ্যে ২৯ জনই ঢাকা জেলার। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ২১ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৮ জন, রংপুর বিভাগে ১৪ জন, সিলেট বিভাগে নয়জন, ময়মনসিংহ বিভাগে আটজন এবং বরিশাল বিভাগে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে গত ২৪ ঘণ্টায়।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মৃত ২০১ জনের মধ্যে ১১৫ জনেরই বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি। ৪৭ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, ২৫ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে, ৯ জনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে, চারজনের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে এবং একজনের বয়স ১১ থেকে ২১ বছরের মধ্যে ছিল। তাদের ১১৯ জন ছিলেন পুরুষ, ৮২ জন ছিলেন নারী। ১৬৫ জন সরকারি হাসপাতালে, ২৩ জন বেসরকারি হাসপাতালে এবং ১২ জন বাসায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। একজনকে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় নেওয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬০৫টি ল্যাবে ৩৫ হাজার ৬৩৯টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ৬৮ লাখ ২৯ হাজার ৮৩২টি নমুনা। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ, আগের দিন ৩১ দশমিক ৪৬ শতাংশ ছিল। দেশে এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৬০ শতাংশ। ঢাকা বিভাগের মধ্যে ঢাকা জেলায় ৩ হাজার ২৮৫ জন, টাঙ্গাইলে ২৭৭ জন, গাজীপুরে ২২০ জন, ফরিদপুরে ১৬৩ জন, নারায়ণগঞ্জে ১৫৬ জন, গোপালগঞ্জে ১৫৩ জন এবং কিশোরগঞ্জে ১১৫ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে গত এক দিনে। চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় ৬১১ জন, কুমিল্লায় ৩০৩ জন, কক্সবাজারে ১৭৬ জন, নোয়াখালীতে ১৫৭ জন এবং ফেনীতে ১২৬ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। রাজশাহী বিভাগের মধ্যে পাবনায় ২৯১ জন, রাজশাহী জেলায় ২৩৪ জন, বগুড়ায় ১৫৪ জন এবং নাটোরে ১২৯ জন নতুন রোগী মিলেছে। খুলনা বিভাগের খুলনা জেলায় ৫৮৫ জন, যশোরে ৩৭৩ জন, কুষ্টিয়ায় ২৩৪ জন, ঝিনাইদহে ১৫৬ জন, চুয়াডাঙ্গায় ১৩০ জন, বাগেরহাটে ১১৮ জন এবং সাতক্ষীরায় ১১১ জনের মাঝে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। রংপুর বিভাগের দিনাজপুরে আরও ১১১ জন এবং ঠাকুরগাঁওয়ে ১০৮ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এ ছাড়া অন্য বিভাগগুলোর মধ্যে সিলেট জেলায় ২১৩ জন, বরিশাল জেলায় ১৭৩ জন, ঝালকাঠিতে ১৬৩ জন, পিরোজপুরে ১২১ জন এবং ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৭ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে গত এক দিনে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল গত বছর ৮ মার্চ; তা ৯ লাখ পেরিয়ে যায় গত ২৯ জুন। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর গত বছরের ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এ বছর ৪ জুলাই তা ১৫ হাজার ছাড়ায়।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যানুযায়ী-

কুষ্টিয়ায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে একই দিনে ব্যবসায়ী পিতা-পুত্রের করুণ মৃত্যু হয়েছে। বুধবার দুপুর সোয়া ১টায় কুষ্টিয়া করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান পিতা হাজী আবদুল আজিজ শেখ (৭৫)। সন্ধ্যা ৬টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের একটি ক্লিনিকে মারা যান ছেলে মতিয়ার রহমান মতি (৪৫)। খুলনায় করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে বিভাগে সর্বোচ্চ ৬০ জনের মৃৃত্যু হয়েছে। এ সময় করোনা শনাক্ত হয়েছেন সর্বোচ্চ ১ হাজার ৯০০ জন। এর আগে ৫ জুলাই বিভাগে সর্বোচ্চ ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ ছাড়া ৬ জুলাই ১ হাজার ৮৬৫ জন করোনা শনাক্ত হয়।

সিলেটে অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে করোনা সংক্রমণ। গেল কয়েকদিন থেকে প্রতিদিন নমুনা পরীক্ষায় তিন শতাধিক আক্রান্ত শনাক্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে করোনায় প্রাণহানি। আক্রান্ত শনাক্ত বাড়ায় বাড়ছে হাসপাতালে রোগীর চাপ। আইসিইউ হয়ে উঠেছে সোনার হরিণ। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কভিড আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য আইসোলেশন সিটও মিলছে না। রংপুর বিভাগে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্তের অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। শনাক্তের হার প্রায় ৪২ শতাংশ। বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কুমিল্লায় রেকর্ড সংখ্যক ৩৯৩ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। নতুন করে মৃত্যু হয়েছে আরও সাতজনের। বুধবার সন্ধ্যায় জেলা সিভিল সার্জন ডা. মীর মোবারক হোসাইন এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া মঙ্গলবার বিকাল থেকে বুধবার বিকাল পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ল্যাবে ৮৬১ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯৩ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ১৮০ জনই কুমিল্লা নগরীর বাসিন্দা। যা এই পর্যন্ত আক্রান্তের সর্বোচ্চ সংখ্যা। আক্রান্তের হার ছিল ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ।

সর্বশেষ খবর