শনিবার, ৫ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

রোমানিয়ায় নেওয়া হচ্ছে উদ্ধার ২৮ নাবিককে

বাংকারে সুস্থ আছেন সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে জাহাজ পাঠানোয় দায়িত্বহীনতা নিয়ে প্রশ্ন

কূটনৈতিক প্রতিবেদক ও নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

রোমানিয়ায় নেওয়া হচ্ছে উদ্ধার ২৮ নাবিককে

যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে আটকে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ থেকে উদ্ধার হওয়া নাবিকরা এখন সেখানে একটি সেইফ হোমে আছেন। বাংলাদেশি প্রবাসী এক ব্যবসায়ীর তত্ত্বাবধানে এই সেইফ হোমে তারা আপাতত স্বস্তিতে আছেন। তবে তাদের শিগগিরই দেশে ফেরানো হবে। এ জন্য তাদেরকে পার্শ¦বর্তী দেশ রোমানিয়ায় নেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে সরকার। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন গতকাল সাংবাদিকদের জানান, ইউক্রেন থেকে প্রথমে তাদেরকে পাশের দেশ মলদোভায় নেওয়া হবে। সেখান থেকে নেওয়া হবে রোমানিয়ায়। এরপর রোমানিয়া থেকে দেশে ফেরানো হবে। উদ্ধার হওয়া নাবিকদের সঙ্গে নিহত নাবিকের মৃতদেহও নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। গতকাল সকালে জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার বাংলাদেশে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানিয়েছেন- সবাই সুস্থ আছেন। চট্টগ্রাম নগরের বারিক বিল্ডিং এলাকায় মেরিন প্রকৌশলীদের সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএমওএ) কার্যালয়ে বিএসসি মালিকানাধীন ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজের সার্বিক পরিস্থিতি এবং নাবিকদের অবিলম্বে ফেরত আনার দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আসেন কয়েকজন নাবিকের স্বজন। এ সময় তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। চিফ ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুক তুহিনের মা মোছাম্মৎ খায়রুন নেছা বলেন, সেখানে আটকা পড়ার পর থেকে প্রতিদিন ফোনে কথা হতো। কিন্তু গত দুই দিন আর ফোন করতে পারছে না। শুধু ভয়েস মেসেজ পাঠাচ্ছে আমার ছেলে ও ভাইকে। বলছে- ‘আম্মুকে বলো, আমার জন্য দোয়া করতে। শিপ থেকে নেমে  গেছে। এখন বাংকারে অবস্থান করছে। সন্তানের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বয়োবৃদ্ধ খায়রুন নেছা। তিনি বলেন, আমি খুব চিন্তায় আছি ছেলের জন্য। কীভাবে আমার ছেলেটা বাংলাদেশে এসে পৌঁছাবে, আমি জানি না। আমার ছেলেটি সুস্থ শরীরে ফিরে আসুক। আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ শরীরে ফিরিয়ে আনেন। ওমর ফারুক তুহিনের ছোট ভাই ওমর শরীফ তুষার বলেন, সকাল ৯টার দিকে মেসেজ পাঠিয়েছিলাম। জবাবে বলেছে, বাংকারে আছি, সুস্থ আছি। অন্য নাবিকরা বেশির ভাগই ঘুমাচ্ছিলেন। তখন ভোর রাত। সবাই ভালো আছেন বলে জানিয়েছেন। ওখানে বেশ ঠান্ডা। তাপমাত্রা কম। তবে বাংকার থেকে কখন তারা পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হবেন সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে পারেননি। শিপিং করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন আমীর মো. আবু সুফিয়ান চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমান স্থান থেকে বের হতে অন্তত দু-এক দিন সময় লাগতে পারে। প্রকৌশলী হাদিসুর রহমান আরিফের মৃতদেহ যে কোনোভাবে, যত কষ্টই হোক যাতে দেশে নিয়ে আসা যায়, সেই চেষ্টাই চলছে।

সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, প্রথমে নাবিকদের পোল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করা হচ্ছিল। কিন্তু ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যেহেতু সড়ক পথেই যেতে হবে এ কারণে নিকটতম নিরাপদ রুট বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। নাবিকরা এখন যেখানে অবস্থান করছে সেখান থেকে পোল্যান্ডের দূরত্ব ৮০০ কিলোমিটার, কিন্তু মলদোভার দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার। এ কারণে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যে কোনো নিরাপদ সময় বিবেচনায় তাদেরকে স্থানান্তর করা হবে। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, নাবিকরা সবাই সুস্থ আছেন। তারা ইউক্রেনের অলভিয়া পোর্ট এলাকার এক বাংলাদেশি প্রবাসী ব্যবসায়ীর তত্ত্বাবধানে আছেন। নাবিকদের জাহাজ থেকে উপকূলে আনা এবং আশ্রয় দেওয়া সবই করেছেন ওই প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। তিনি নিজ থেকে নাবিক-ক্রুদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। ওই ব্যবসায়ীর  মাধ্যমেই খোঁজখবর অন্যান্য সহায়তা করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দূতাবাস, জাহাজের লোকাল এজেন্ট ও শিপিং করপোরেশন।

অলভিয়া বন্দরে নোঙর করা বিএসসির জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধি বুধবার বাংলাদেশ সময় রাতে হামলার শিকার হয়। এতে জাহাজটির থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান আরিফ নিহত হন। বেঁচে থাকা নাবিকরা ভিডিও বার্তায় তারা নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার আকুতি জানান। পরে তাদের গতকাল উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া নাবিক-ক্রুদের মধ্যে রয়েছেন- সেলিম মিয়া, রমা কৃষ্ণ বিশ্বাস, মো. রোকনুজ্জামান রাজিব, ফারিয়াতুল জান্নাত তুলি, ফয়সাল আহমেদ সেতু, মোহাম্মদ ওমর ফারুক, সৈয়দ আসিফুল ইসলাম, রবিউল আউয়াল, সালমান সরওয়ার সামি, ফারজানা ইসলাম মৌ, মো. শেখ সাদি, মো. মাসুদুর রহমান, মো. জামাল হোসাইন, মোহাম্মদ হানিফ, মো. আমিনুর ইসলাম, মো. মহিন উদ্দিন, হোসাইন মোহাম্মদ রাকিব, সাজ্জাদ ইবনে আলম, নাজমুল উদ্দিন, মো. নজরুল ইসলাম, সরওয়ার হোসাইন, মো. মাসুম বিল্লাহ, মোহাম্মদ হোসাইন, মো. শফিকুর রহমান, মো. আতিকুর রহমান ও মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন। জানা যায়, জাহাজটি ইউক্রেনের বন্দর থেকে পণ্যবোঝাই করে ইতালির বন্দরে যাওয়ার কথা ছিল। তুরস্কের এরেগলি বন্দর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি খালি জাহাজটি অলভিয়া বন্দরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ২২ ফেব্রুয়ারি এমভি বাংলার সমৃদ্ধি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে পৌঁছে। যুদ্ধ শুরুর পরও খালি জাহাজ পাঠিয়ে শিপিং করপোরেশন দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে বলে প্রশ্ন তুলেছে নাবিকদের সংগঠন মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন।

যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জাহাজ ইউক্রেন যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন : জয়েন্ট ওয়ার কমিটি গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অলিভিয়া পোর্টের বহির্নোঙরকে যুদ্ধকবলিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ সেখানে গিয়ে পৌঁছে ২২ ফেব্রুয়ারি। তাহলে বিএসসি কেন যুদ্ধকবলিত একটি বন্দরে জাহাজটি নোঙর করল। এমন প্রশ্ন করল সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজের নাবিকদের সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএমওএ)। এ নিয়ে সংগঠনটি সংবাদ সম্মেলনও করে। জানা যায়, জাহাজ হামলার শিকার হওয়ার বিষয় নিয়ে বিএমএমওএ জাহাজটির মালিক বিএসসিকে ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সংগঠনটি। এর মধ্যে আছে ১৫ ফেব্রুয়ারি বন্দর এলাকাটিকে যুদ্ধকবলিত অঞ্চল ঘোষণার পরও কেন ২২ ফেব্রুয়ারি জাহাজটি ওই অঞ্চলে প্রবেশ করল? চার্টার পার্টি বিধিমালা অনুযায়ী কোনো জাহাজ কোম্পানি তার জাহাজের নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধকবলিত এবং জলদস্যুপ্রবণ এলাকায় জাহাজ যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে। অথচ এক্ষেত্রে মালিক কর্তৃপক্ষ বিএসসির পক্ষে থেকে জাহাজটিকে যুদ্ধকবলিত এলাকায় যাওয়ার অনুমতি দিল কেন? যুদ্ধকবলিত এলাকায় আটকে যাওয়ার পর জাহাজটির নাবিকদের নিরাপদে সরিয়ে আনার কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি। বিএমএমওএর সাধারণ সম্পাদক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মো. সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য জেনেছি, তার ভিত্তিতে বলছি, জাহাজটি ইউক্রেনে যাওয়া এড়ানো যেত। এখানে বিএসসির গাফিলতি ছিল বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। জাহাজ পরিচালনায় বিএসসির সার্বিক অব্যবস্থাপনার কারণে আমাদের আজ এই মৃত্যু ও নাবিকদের দুর্দশা দেখতে হয়েছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় মূলব্যান সম্পত্তি বাংলার সমৃদ্ধির চরম ক্ষতি হয়েছে। এ মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির দায় কে নেবে? তিনি বলেন, ‘বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিল (বিআইএমসিও) ওয়ার রিস্ক ক্লজ ফর টাইম চার্টারিং (কনওয়ারটাইম ২০১৩) এর বি ধারায় বলা আছে- যুদ্ধের ঝুঁকি আছে এমন কোনো স্থানে মালিক বা মাস্টার যুক্তিসঙ্গত কারণে যেতে বাধ্য নয়।

তাহলে কোন পরিস্থিতিতে কোন শর্তের কারণে বিএসসি জাহাজ পাঠাল, সেটি আমাদের প্রশ্ন। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি চারটি দাবি তুলে। এর মধ্যে আছে- হাদিসুর রহমানকে ‘রাষ্ট্রীয় বীর’ ঘোষণা করে তার মৃতদেহ দেশে এনে দাফনের ব্যবস্থা করা, ২৮ নাবিককে অতি দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা, জাহাজ পরিচালনায় বিএসসির গাফিলতি তদন্তে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি করা ও সেই কমিটিতে বিএমএমওএর দুজন প্রতিনিধি রাখা এবং রকেট হামলার শিকার জাহাজ ধ্বংস থেকে রক্ষা করায় নাবিকদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ও পুরস্কার দেওয়া।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর