বুধবার, ৬ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

শরীরে আগুন দিয়ে ব্যবসায়ীর মৃত্যুতে তোলপাড়

বুকভরা কষ্ট নিয়ে মারা গেছেন, গ্রেফতার হেনোলাক্সের মালিক ও তার স্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

শরীরে আগুন দিয়ে ব্যবসায়ীর মৃত্যুতে তোলপাড়

গায়ে আগুন দিয়ে ঠিকাদার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান ওরফে গাজী আনিসের মৃত্যুর ঘটনায় হেনোলাক্স গ্রুপের কর্ণধার নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গতকাল আনিসের বড় ভাই নজরুল ইসলাম শাহবাগ থানায় এ মামলা করেন বলে জানান ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুদ হাওলাদার। ওসি বলেন, মামলায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়েছে। এদিকে, গতকাল রাজধানীর উত্তরা এলাকা থেকে হেনোলাক্স গ্রুপের কর্ণধার ডা. নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৩-এর সদস্যরা। তারা বলছেন, বহুল আলোচিত জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্বরে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে গাজী আনিসের মৃত্যুর ঘটনায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে ওই দম্পতিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

জানা গেছে, ৫০ বছর বয়সী গাজী আনিসের বাড়ি কুষ্টিয়ায়, তিনি ঠিকাদারি ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। এক সময় কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। স্থানীয়রা তাকে গাজী আনিস নামেই চেনেন। এর আগে সোমবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাব ফটকের ভিতরে খোলা স্থানে আনিস নিজের গায়ে আগুন দেন। শোয়া অবস্থায় তার গায়ে আগুন জ্বলছে দেখে আশপাশ থেকে সবাই ছুটে যান। তারা পানি ঢেলে আগুন নেভান। তবে ততক্ষণে তার গায়ের পোশাক সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। পরে তাকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সকাল সোয়া ৬টায় তার মৃত্যু হয় বলে জানান বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন। গাজী আনিসকে বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়ার সময় তার সঙ্গে ছিলেন মোহাম্মদ আলী নামে এক সাংবাদিক। তিনি বলেছিলেন, তার সঙ্গে আনিসের একটু কথা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, একটি কোম্পানির কাছ থেকে তিনি ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা পাবেন। ওই কোম্পানি তা দিচ্ছে না। পাওনা পেতে তিনি এর আগে মানববন্ধন করেছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তাই তিনি নিজের গায়ে আগুন দেন।

মামলায় নজরুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন, ২০১৬ সালে হেনোলাক্সের কর্ণধার ডা. নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের সঙ্গে পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা হয় তার ভাই ‘আনিসুর রহমানের’। তারা একসঙ্গে বিদেশ ভ্রমণও করেন। তাদের মধ্যে ‘খুবই সখ্য’ গড়ে ওঠে। ২০১৮ সালে তারা (নুরুল দম্পতি) হেনোলাক্স কোম্পানিতে ‘লভ্যাংশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে’ বিনিয়োগ করার জন্য আনিসুরকে অনুরোধ করেন।

তাদের অনুরোধে বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রথমে ১ কোটি এবং পরে তার বন্ধুর কাছ থেকে আরও ২৬ লাখ টাকা নিয়ে আনিসুর হেনোলাক্সে বিনিয়োগ করেন। এ বিনিয়োগের প্রাথমিক চুক্তি সম্পাদন করা হলেও হেনোলাক্সের পক্ষ থেকে ওই দুজন চূড়ান্ত চুক্তি সম্পাদন করতে ‘গড়িমসি করেন’। এরই মধ্যে কিছুদিন আমার ভাইকে লভ্যাংশ দিলেও পরে তা বন্ধ করে দেয় এবং চূড়ান্ত চুক্তি করতে গড়িমসি করেন।

পরে এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে নুরুল আমিন বিভিন্ন লোক দিয়ে ‘নানাভাবে হেনস্তা এবং ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করেন’ বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে। লভ্যাংশসহ এখন পর্যন্ত ৩ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে দাবি করে এজাহারে নজরুল ইসলাম বলেন, ওই টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করেও না পেয়ে কুষ্টিয়ায় হেনোলাক্সের দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন আনিসুর। এর একটি চেক ডিজঅনার এবং আরেকটি হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ছিল।

গত ৪ জুলাই বেলা ১২টার দিকে আনিসুর তাকে (ভাই নজরুল ইসলামকে) ফোন করে জানান, ওই দিন বিকালে পাওনা টাকার চেক হেনোলাক্সের কর্ণধার ডা. নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিন দেবেন বলে তাকে জানিয়েছেন। কিন্তু বিকালে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো চেক দেননি। এরপরই জাতীয় প্রেস ক্লাবে এসে আনিস গায়ে দাহ্য পদার্থ ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন এবং পরে মারা যান। ‘প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চেক না দিয়ে এবং বিরূপ আচরণ করে’ আনিসুরকে আত্মহত্যা করতে ‘প্ররোচিত করা হয়েছে’ বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।

মামলার বাদী নজরুল ইসলাম বলেন, তার ভাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের যখন দায়িত্বে ছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের দুঃসময়। সে সময় সংগঠনের পেছনে তার অবদান অনেক। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরেও তিনি কখনো কোথাও তার সেই পরিচয় ব্যবহার করতেন না, প্রভাব খাটাতেন না। তিনি আমার কাছেও বেশি কিছু বলতেন না। খুবই শান্ত স্বভাবের ছিলেন এবং নিজেই চেষ্টা করতেন সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য।

কেন শরীরে আগুন দেন গাজী আনিস : গাজী আনিসের একজন বন্ধু তৌহিদুল ইসলাম জানান, হেনোলাক্স গ্রুপের মালিক এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে ২০১৬ সালে তার পরিচয় হয়েছিল। এরপর তাদের সঙ্গে একটা পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। তারা একসঙ্গে ভারতে একাধিক ট্যুরেও গিয়েছিলেন। সেই সম্পর্কের খাতিরে ব্যবসা করার জন্য ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা নিয়েছিলেন ফাতেমা আমিন। প্রতি মাসে ৫ লাখ টাকা করে দেওয়ার কথা ছিল। দুই বছর পর একবারে ৩ কোটি টাকা দেওয়ার কথা ছিল। দুই-তিন মাস ব্যবসার লভ্যাংশ দিয়েছিলেন। এরপর তারা সেটা বন্ধ করে দেন। বড় ভাইয়ের এলপিআরের টাকা, বন্ধু এবং স্বজনদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে এসব টাকা নিয়েছিলেন গাজী আনিস। লভ্যাংশ দেওয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে টাকা এনেছিলেন। তারাও টাকা ফেরতের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। সেই টাকা উদ্ধারের জন্য সম্প্রতি তিনি ঢাকায় একাধিক সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। নানাজনের কাছে ধরনা দিয়েছিলেন। অনেক চেষ্টার পর ৭৭ লাখ টাকা উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। কিন্তু লভ্যাংশসহ বাকি টাকা ফেরত পাননি। গাজী আনিসের এসব লেনদেনের কোনো ব্যাংক ডকুমেন্ট ছিল না। সরল বিশ্বাসের ভিত্তিতে টাকা দিয়েছিলেন।

নিহতের ভাই নজরুল ইসলাম জানান, তার ভাই (গাজী আনিস) প্রথমে গাড়ির ব্যবসা শুরু করেছিলেন। পরে সেটা ছেড়ে হেনোলাক্সের মালিকের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। সেখানে প্রতারণার শিকার হওয়ার পর সোমবার নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন।

ফেসবুকে আনিসের স্ট্যাটাস : গত ২৯ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে হেনোলাক্স গ্রুপে সোয়া কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ‘প্রতারিত’ হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন আনিস। তার দুই দিন পর ৩১ মে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি হেনোলাক্স গ্রুপের মালিকের সঙ্গে তার সম্পর্কের সূত্রপাত এবং বিনিয়োগ করে প্রতারিত হওয়ার অভিযোগগুলো তুলে ধরেন। আনিস সেখানে লেখেন, ‘২০১৮ সালে কলকাতা হোটেল বালাজিতে একসঙ্গে অবস্থানকালে উনারা আমাকে হেনোলাক্স গ্রুপে বিনিয়োগের এবং যথেষ্ট লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে বলে জানান। আমি প্রথমে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেও পরবর্তীতে রাজি হই এবং প্রাথমিকভাবে ১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করি। পরবর্তীতে তাদের পীড়াপীড়িতে আরও ২৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি (অধিকাংশ টাকা ঋণ হিসেবে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে নেওয়া)। বিনিয়োগ করার সময় পরস্পরের প্রতি সম্মান এবং বিশ্বাসের কারণে এবং তাদের অনুরোধে চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তি করা হয়নি, তবে প্রাথমিক চুক্তি করা হয়েছে। বিনিয়োগ পরবর্তী চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তিপত্র সম্পাদন করার জন্য বারবার অনুরোধ করি, কিন্তু উনারা গড়িমসি করতে থাকেন। একপর্যায়ে উনারা প্রতি মাসে যে লভ্যাংশ প্রদান করতেন সেটাও বন্ধ করে দেন এবং কয়েকবার উনাদের লোকজন দ্বারা আমাকে হেনস্তা, ব্ল্যাকমেল করেন এবং করার চেষ্টা করেন। বর্তমানে লভ্যাংশসহ আমার ন্যায্য পাওনা ৩ কোটি টাকার অধিক।’

সর্বশেষ খবর