মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের গত ১৩ মে’র নিয়োগ পরীক্ষার ইডেন কলেজ কেন্দ্র সমন্বয় করার দায়িত্বে ছিলেন চন্দ্র শেখর হালদার মিল্টন। টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রশ্নপত্রগুলো নিয়ে মাউশির এক অফিস সহকারী ইডেন কলেজ কেন্দ্রে রওনা দিলেও সেই গাড়িতে ছিলেন না মিল্টন। ওই সময় তিনি ব্যস্ত ছিলেন প্রশ্ন ফাঁস এবং তার সমাধান নিয়ে। প্রশ্নের সমাধান করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন শিক্ষার্থী। আর প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে সাইফুলের কাছে পাঠিয়েছিলেন মিল্টন। চাঞ্চল্যকর এই মামলার তদন্তে এরই মধ্যে বিষয়গুলো নিশ্চিত হয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে, রাজধানীর সেগুনবাগিচায় মিল্টনের আড়াই কোটি টাকা দামের ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছে একাধিক সংস্থা। এর বাইরেও মিল্টন নামে-বেনামে ২-৩ কোটি টাকার জমি কিনেছেন গত কয়েক বছরে। তবে এই মামলার ঝামেলায় পড়ে এরই মধ্যে বিভিন্নভাবে ২৫ লাখ টাকার মতো খরচ করে ফেলেছেন তিনি। ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি তদন্ত করছি। এর আগে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।
অভিযোগ উঠেছে, মাউশিতে ডেপুটেশনে থাকা শিক্ষা ক্যাডারের ৩১ ব্যাচের নবীন কর্মকর্তা মিল্টন। তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের থোরাই কেয়ার করেন মিল্টন। গত ২১ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (সরকারি কলেজ-২) চৌধুরী সামিয়া ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত এক আদেশে চন্দ্র শেখর হালদারকে মাদারীপুর সরকারি কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রভাষক হিসেবে বদলি করা হয়। বিষয়টি জানার পর মাউশির কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার রুমে গিয়ে রীতিমতো হুঙ্কার ছাড়েন তিনি। তাকে বদলি করার পেছনে যারা ভূমিকা রেখেছেন উল্টো তাদের দেখে নেওয়ার হুমকি দেন তিনি। গ্রেফতার ও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানোর পরও শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবেও বরখাস্ত করেনি। চন্দ্র শেখর ও তার স্ত্রীর নামে যৌথ অ্যাকাউন্টে বিগত চার বছরে অন্তত ২০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা তথ্য পেয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগে গত বছরের নভেম্বরে বাতিল হওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের ক্যাশ অফিসার পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাটি অনেকটা আড়াল হয়ে গেছে। ওই সময় ডিবি পাঁচজনকে গ্রেফতার করে জানিয়েছিল যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ওই চক্রটি ৬০ কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে। বুয়েটের এক শিক্ষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।জানা গেছে, গত ১৩ মে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) ৫১৩টি পদে নিয়োগের জন্য লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ৫১৩টি পদের জন্য পরীক্ষার্থী ছিলেন ১ লাখ ৮৩ হাজার। পরীক্ষা চলাকালে গোয়েন্দা দল খবর পায় প্রশ্ন ফাঁসের। ইডেন কলেজ কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্রের উত্তরসহ চাকরি প্রার্থী সুমন জোয়ার্দার নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তার প্রবেশ পত্রের উল্টো পিঠে ৭০টি এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তর লেখা ছিল। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পটুয়াখালীর খেপুপাড়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক সাইফুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। সুমন ও সাইফুলকে এক দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তারা পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি স্বীকার করেন।
গত ২৫ জুলাই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে মিল্টনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ইতিপূর্বে এ মামলায় গ্রেফতারদের দেওয়া তথ্য বিবরণী ও সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে লালবাগ থানার মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হলে আদালত এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষক আবদুল খালেক বাদী হয়ে রাজধানীর লালবাগ থানায় মামলা করেন। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পরীক্ষা শুরু হয় বিকাল ৩টায়। পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সুমন জোয়ার্দার জানান, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দুপুর ২টা ১৮ মিনিটে তার মোবাইলে পটুয়াখালীর গণিতের শিক্ষক সাইফুল ও টাঙ্গাইলের খোকন উত্তরপত্র পাঠায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পটুয়াখালীর একটি স্কুলের ল্যাব সহকারী সোহাগের কাছে উত্তরপত্র পাঠায় চক্রটি। এই চক্রে মাউশির অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত রয়েছেন। ওই দিন ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সমাধান করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন শিক্ষার্থী। তাদেরও খুঁজছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।
গ্রেফতারদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১৪ মে পটুয়াখালী সরকারি কলেজের প্রভাষক রাশেদুল, মাউশির উচ্চমান সহকারী আহসান হাবীব ও অফিস সহকারী নওশাদকে গ্রেফতার করা হয়। এর এক সপ্তাহ পরই নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করে মাউশি। তদন্তে উঠে এসেছে, সোহাগ ও সাইফুলের পাশাপাশি মিল্টন তার আত্মীয় তাপসী রায়ের কাছে তার ছেলে দ্বীপসোনার জন্যও প্রশ্নপত্র পাঠিয়েছিলেন। তবে প্রশ্নপত্রের সমাধান করেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন শিক্ষার্থী।
ডিবি কর্মকর্তারা জানান, মিল্টন মাউশিতে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। তারা নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বদলি ও এমপিওভুক্তি, পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিবেদন দেওয়াসহ নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। মাউশির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রটি মাউশি কর্মকর্তা মিল্টন ফাঁস করেছিলেন। তিনি ওই নিয়োগ পরীক্ষার ইডেন কলেজ কেন্দ্র সমন্বয় করার দায়িত্বে ছিলেন। মাউশি কার্যালয় থেকে প্রশ্ন নিয়ে কেন্দ্রে যাওয়ার সময় তিনি প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে সাইফুলের কাছে পাঠিয়েছিলেন।
একাধিক সূত্র বলছে, বিআইএফইউর অনুসন্ধানে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের পেছনে বুয়েটের এক শিক্ষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১০ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পায়। গত বছরের ৭ নভেম্বর ৫টি ব্যাংকে ক্যাশ অফিসার পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপরই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠার পর ১১ নভেম্বর পরীক্ষা বাতিল করে। ডিবি পুলিশের হাতে জনতা ব্যাংকের অফিসার শামসুল হক শ্যামল, রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলন, পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মুস্তাফিজুর রহমান মিলন, আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির টেকনিশিয়ান মুক্তারুজ্জামান রয়েল এবং রাইসুল ইসলাম স্বপন গ্রেফতার হয়। পরে আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস সহায়ক দেলোয়ার হোসেন, পারভেজ মিয়া এবং প্রেসকর্মী রবিউল আউয়ালকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে চাঞ্চল্যকর তথ্য পায়। বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই) বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান নিখিল রঞ্জনের মাধ্যমেই এই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। বিএফআইইউ তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অনুসন্ধান করে ১০ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পায়।