বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
নৌকাডুবিতে এখনো মিলছে লাশ

বিভীষিকা ভুলতে পারছে না বেঁচে ফেরা শিশুরা

পঞ্চগড় প্রতিনিধি

বিভীষিকা ভুলতে পারছে না বেঁচে ফেরা শিশুরা

পঞ্চগড়ে নৌকাডুবিতে বেঁচে ফেরা শিশুরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় গতকাল আরও একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তার নাম হিমালয়। এ নিয়ে এ পর্যন্ত ৬৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হলো। আরও তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানা গেছে। এদিকে আত্মীয়ের লাশের সন্ধ্যানে করতোয়া পাড়ে স্বজনরা এখনো আহাজারি করছেন। জীবিত পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন তারা। এখন অন্তত লাশ চাচ্ছেন স্বজনরা। উদ্ধার অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানানো হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, দেড় মাস আগে বিয়ে করেন হিমালয়। নববিবাহিত স্ত্রী বন্যাসহ তিনি বদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন। নৌদুর্ঘটনায় স্ত্রী বেঁচে গেলেও হিমালয় পানিতে ডুবে যান।

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামুন হাটে রবিবার করতোয়া নদীতে ওই নৌকাডুবির ঘটনায় তথ্য কেন্দ্রের মতে আরও তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন। এর একজন নারী, দুজন পুরুষ। চতুর্থ দিন গতকাল ভোর ৫টা থেকে আবারও উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে ১২টি দল। ঘটনার দিন রবিবার ২৫, সোমবার ২৫, মঙ্গলবার ১৭ ও বুধবার একটি লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে নারী ৩০, শিশু ২১ এবং পুরুষ ১৮ জন রয়েছে। নিহতদের মধ্যে দেবীগঞ্জ উপজেলার ১৭, বোদা ৪৬, আটোয়ারী ২, ঠাকুরগাঁও সদর ৩ ও পঞ্চগড় সদরের একজন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান আজ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবেন বলে জানা গেছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেবেন। অধিকতর তদন্তের স্বার্থে তদন্ত কমিটি আরও তিন দিন সময় নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দীপংকর রায়।

বিভীষিকা ভুলতে পারছে না বেঁচে ফেরা শিশুরা : বেঁচে ফেরা শিশু তনুশ্রী। সারাক্ষণ দাদির সঙ্গেই কাটত তার। রবিবার দাদির সঙ্গে মহালয়া পূজা দেখতে যায় সে। আউলিয়ার ঘাটে নৌকায় উঠে আনন্দ যেন থামে না তার। কিন্তু এমন বিভীষিকা অপেক্ষা করছে ভাবতেও পারেনি সে। একটু পরেই নৌকাটি কাত হয়ে যায়। তীর্থযাত্রীরা পড়ে যান করতোয়ার গভীর জলে।  তনুশ্রী জানায়, পানিতে কে যেন তার চুল ধরে টানছিল। সাঁতার কাটতে থাকে সে। একটু পর কে যেন তাকে তুলে আনে ডাঙ্গায়। পরে সে শুনতে পায় দাদি প্রমিলা রায় নিখোঁজ। পরদিন দাদির লাশ পাওয়া যায়। কাঁদতে কাঁদতে বিভীষিকাময় নৌকাডুবির বর্ণনা করছিল সে। তার চোখে মুখে আতঙ্ক। কৃষক বাবা যামিনী রায়ের প্রথম সন্তান তনুশ্রী লক্ষ্মীগড় ডাঙ্গাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। সে সাঁতার জানত। পরিবার জানায়, দাদির শোকে আর আতঙ্কে তনুশ্রী বাড়ির কারও সঙ্গে কথা বলে না। কিছু খায় না সে। মাড়েয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিঠুন রায়ের মা জানান, ছেলেটাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেই। ঘণ্টাখানেক পরে শুনি নৌকা ডুবে গেছে। চিৎকার করছিলাম আর দৌড়াচ্ছিলাম। রাস্তায় দেখি ভেজা কাপড়ে ছেলে ফিরে আসছে। আমার ছেলে এখন চুপচাপ হয়ে গেছে। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মিঠুন জানায়, মাঝে মাঝে শরীর কাঁপে। রাতে ঘুম আসে না। খালি নৌকার কথা মনে পড়ে। বড়বোন ঈশিতা ডুবে যাওয়ার সময় ছোট ভাই দর্পণ টেনে তুলেছিল। তারা দুজনেই মাড়েয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী। তারা জানায়, একদম ভালো লাগে না। তাদের বাবা-মা জানান, ছেলেটা স্কুলে যায় না। মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। পড়ালেখা করতে পারে না। নৌকাডুবির ঘটনায় ঠিক কতজন বেঁচে ফিরেছেন তার তথ্য পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে অনেক শিশু রয়েছে। এই শিশুদের আতঙ্ক এখনো কাটেনি। এদের শরীর ও মনে ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শিশু বিশেষজ্ঞরা। পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মনোয়ার হোসেন জানান, এরকম ঘটনায় শিশুদের মনোজাগতিক পরিবর্তন ঘটতে পারে। যা তার ভবিষ্যৎ ওলট-পালট করে দিতে পারে। এর প্রভাব থেকে নিরাপদ রাখতে শিশুদের কাউন্সিলিং করতে হবে। তাদের আনন্দ দিতে হবে। কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) দীপংকর রায় জানান, জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শিশুদের জন্য কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

সর্বশেষ খবর