সোমবার, ২১ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সারা দেশে রেড অ্যালার্ট

দিনদুপুরে আদালতপাড়া থেকে ফাঁসির দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়েছে সহযোগীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

সারা দেশে রেড অ্যালার্ট

সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ে দুই আসামির পালানোর দৃশ্য

পুলিশের চোখে স্প্রে ছুড়ে রাজধানীর আদালতপাড়া থেকে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়েছে তাদের সহযোগীরা। গতকাল দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। এর পর পরই সারা দেশে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। দুপুর থেকেই রাজধানীতে প্রবেশ-বের হওয়ার ১৬টি স্পটকে রাখা হয়েছে বিশেষ নজরদারিতে। এ ছাড়া রাজধানী সংলগ্ন নদী এবং প্রতিটি অলিগলিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিশেষ টহল দল নামানো হয়েছে। রাজধানীসহ এর আশপাশের  জেলাগুলোতে বসানো হয়েছে বিশেষ চেকপোস্ট। সীমান্তবর্তী সবগুলো পয়েন্টে নজরদারি বাড়াতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা।

এদিকে ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পুলিশ। দুই জঙ্গিকে ধরতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। সন্ধ্যায় রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় ২০ জনকে আসামি করে পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলাও করা হয়েছে।

এর আগে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর রায়সাহেব বাজার মোড়সংলগ্ন ঢাকার সিজেএম আদালত ফটকের সামনে থেকে জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যার দায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। তারা দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের ওপর বিশেষ ধরনের স্প্রে ছিটিয়ে তাদের ছিনিয়ে নেয়। দুই আসামিকে ছিনিয়ে নিতে পারলেও দুজনকে পুলিশ আটকাতে সক্ষম হয়েছে। পালিয়ে যাওয়া আসামিরা হলো, মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব। পালিয়ে যাওয়া জঙ্গি শামীমের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতকের মাধবপুর গ্রামে। সোহেলের বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারীর ভেটোশ্বর গ্রামে। আটকাতে পারা আসামি হলেন- দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আবদুস সবুর ওরফে আবদুস সামাদ ও ব্লগার অভিজিত হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি আরাফাত রহমান।

বিকাল ৪টার দিকে আদালতপাড়া এলাকায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের প্রধান মোহাম্মদ হারুন আর রশীদ বলেন, দুটি মোটরসাইকেলে করে চারজন লোক এসে পুলিশের চোখে স্প্রে করে আসামিদের ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তারা প্রকাশক দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি। এখন তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গি ও মোটরসাইকেল চালকদের ধরতে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে।

জানা গেছে, ঘটনার পর পরই আদালতপাড়া সংলগ্ন এলাকাগুলোর সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। তার পরই শুরু হয়েছে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণের কাজ। একই সঙ্গে রাজধানীর প্রবেশ এবং বের হওয়ার স্পটগুলোর প্রতিটি যানবাহনে তল্লাশি শুরু করেছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে ফয়সাল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওইদিন তার স্ত্রী শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গিকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন আদালত।

মোড়ে মোড়ে তল্লাশি : সারা দেশে রেড অ্যালার্ট জারির পর রাজধানীর মোড়ে মোড়ে পুলিশি তল্লাশি চলছে। রাজধানীর নিউমার্কেট, ঢাকা কলেজ, বাটা সিগন্যাল, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, বিজয় সরণি, মগবাজার, শান্তিনগর, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের চেকপোস্টও বসানো হয়েছে। এ সময় সন্দেহভাজন গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করতে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যদের।

সব আদালতে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ : ঢাকার আদালতপাড়া থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনার পর পরই সারা দেশের সব আদালতে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশনা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। ঢাকার আদালত থেকে দুই আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার পর পরই এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন।

২০ জনকে আসামি করে মামলা : পুলিশের চোখে ¯ন্ডেপ্র মেরে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে এ মামলায় ২০ জনকে আসামি করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মামলার বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানান।

তদন্ত কমিটি : সাজাপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি পলায়ন সংক্রান্ত বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এ কে এম হাফিজ আক্তারকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যদের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল বিকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক স্বাক্ষরিত এক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) বিপ্লব কুমার সরকার, যুগ্ম কমিশনার (সিটিটিসি) ড. এ এইচ এম কামরুজ্জামান, গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান ও ডিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (সিআরও) মো. মুনতাসের রহমান। কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আগামী ৩ (তিন) কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটি জঙ্গি পলায়ন সংক্রান্ত দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ এবং ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত সুপারিশমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে কাজ করবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন : দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে আমরা রেড অ্যালার্ট জারি করেছি। আমাদের পুলিশ হন্যে হয়ে তাদের খুঁজছে। আশা করি, শিগগিরই তাদের ধরতে পারব। আমরা সীমান্ত এলাকাগুলোতেও বলে দিয়েছি, তারা যেন পালিয়ে যেতে না পারে। গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

মন্ত্রী বলেন, ঘটনাটি দুঃখজনক বলে আমরা মনে করি। যদি কারও অবহেলা বা গাফিলতি থাকে, যদি কেউ ইচ্ছা করে এ কাজটি ঘটিয়ে থাকে, তার বিরুদ্ধে আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

১০ লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা : আদালতের সামনে থেকে ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি সদস্যকে ধরিয়ে দিলে প্রত্যেকের জন্য ১০ লাখ টাকা করে মোট ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশের জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল আহছান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় আট আসামিকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন আদালত। মামলাটি তদন্ত করে ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। আদালত ওই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করেন। মৃত্যুদন্ড পাওয়া আট আসামি হলেন- মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির, আবদুস সবুর ওরফে আবদুস সামাদ, খাইরুল ইসলাম ওরফে জামিল রিফাত, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব সাজিদ, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন, শেখ আবদুল্লাহ ওরফে জুবায়ের, চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব। তাদের মধ্যে জিয়া ও আকরাম এখনো পলাতক। গতকালের ঘটনার আগে গত ২০১৮ সালের ২ মার্চ সকালে ফিল্মি স্টাইলে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রকাশ্যে প্রিজন ভ্যানে গুলি চালিয়ে ও বোমা মেরে জঙ্গি মামলার তিন আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে।

ক্রাইম কনফারেন্স চলছিল : বিগত সময়ের মতোই গতকাল সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দফতরে (ডিএমপি) শুরু হয়েছিল ক্রাইম কনফারেন্স। ডিএমপির ঊর্ধ্বতন সব কর্মকর্তাসহ সবগুলো থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা (ওসি) ওই ক্রাইম কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন। এ সময়ই খবর আসে আদালতপাড়া থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের। মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে যায় ক্রাইম কনফারেন্স। ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক তাৎক্ষণিকভাবে নির্দেশ দেন সব অফিসারকে মাঠে নেমে কাজ করতে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সব ছুটে যান আদালতপাড়া এলাকায়। পরবর্তীতে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, আমরা বাড়তি সতর্কতা জারি করেছি। এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। জানা গেছে, গতকাল ঢাকার সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালে মোহাম্মদপুর থানার একটি মামলায় তাদের হাজিরা ছিল। হাজিরা দেওয়ার জন্য গারদখানায় নেওয়ার আগেই এ ঘটনা ঘটে।

বিস্মিত দীপনের পরিবার : প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই আনসার আল ইসলাম সদস্য ঢাকার একটি আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পালিয়ে যাওয়ায় বিস্মিত ও আতঙ্কিত তার পরিবারের সদস্যরা। দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান জলি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি শকড। কোনোভাবেই হিসাব মেলাতে পারছি না যে এ ধরনের ঘটনা কীভাবে সম্ভব? এটা খুবই ভয়ের ব্যাপার।’ তিনি বলেন, ‘এটা শুধু আমার জন্য ভয়ের জায়গা না, এটা পুরো দেশের জন্যই একটা ভীতিকর ঘটনা। এই জঙ্গিরা যে শুধু আমাকেই মারতে পারে- তা নয়, আপনাকেও মারতে পারে, যে কাউকে মারতে পারে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর