সোমবার, ২১ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

যেভাবে পালায় দুই জঙ্গি

সাখাওয়াত কাওসার

সকাল ৯টা ১০ মিনিট। ঢাকার নিম্ন আদালত চত্বরে আসা প্রিজন ভ্যানগুলোর একটি এসেছে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে। ওই প্রিজন ভ্যানে করেই আনা হয়েছে প্রকাশক দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ও আবু সিদ্দিক সোহেলসহ ১২ জনকে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার একটি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা মামলার হাজিরা শেষে আসামিদের পুনরায় গারদখানায় নেওয়ার আগেই ঘটে ভয়ংকর ঘটনা। বেলা ১২টা ৪৫ মিনিটের দিকে পুলিশের চোখে-মুখে স্প্রে করে পালিয়ে যান শামীম ও সোহেলসহ চারজন জঙ্গি। তবে স্থানীয় ও আদালত চত্বরে দায়িত্বে থাকা কয়েকজন পুলিশের প্রাণান্তকর চেষ্টায় দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আবদুস সবুর ওরফে আবদুস সামাদ ও ব্লগার অভিজিৎ হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি আরাফাত রহমানকে ধরা সম্ভব হয়।

সন্ধ্যায় ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি আসামিসহ জড়িতদের প্রত্যেককে শনাক্ত করে দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। তাদের গ্রেফতারে ডিএমপি, ডিবি, সিটিটিসিসহ বাংলাদেশ পুলিশের অন্যান্য ইউনিট মাঠে কাজ করছে।

তবে গতকালের চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকজন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাদের ধারণা আগে থেকেই আদালত চত্বরের আশপাশ এলাকায় আসামিদের ঘনিষ্ঠরা উপস্থিত ছিলেন। পরিকল্পনামাফিকই এই অপারেশনটি করেছে তারা।’ তবে প্রশ্ন উঠেছে, ভয়ংকর জঙ্গিদের হাতে স্প্রে এলো কীভাবে?

ঘটনার ঠিক পরপরই গতকাল সরেজমিন আদালতপাড়ায় গিয়ে জানা যায়, পুরো এলাকায় রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সাদা পোশাকে দায়িত্বে রয়েছেন অনেক সংস্থার সদস্যরা। সেখানেই দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কারাগারে প্রিজন ভ্যানের মাধ্যমে আনা ১২ আসামিকে প্রথমে নেওয়া হয় গারদখানায়। সেখান থেকে তাদের নেওয়া হয় ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। হাজিরা শেষে নিয়ম অনুসারে চারজন করে আসামিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল গারদে। একটি হ্যান্ডকাফে আটকানো ছিল দুজন করে আসামি।

এ সময় নুরে আজাদসহ দুই কনস্টেবল তাদের নিয়ে গারদখানায় যাচ্ছিলেন। চার জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব, মাইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত ওরফে সামির, সবুর ও আরাফাতকে একসঙ্গে আটতলা থেকে নিচে নামানো হয়। এ সময় আবু সিদ্দিক সোহেল ও মাইনুল হাসানকে যৌথভাবে একটি হাতকড়া এবং সবুর ও আরাফাতকে যৌথভাবে একটি হাতকড়া পরানো ছিল। এ ছাড়া তাদের চারজন দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। তবে বেলা ১২টা ৪৫ মিনিটের দিকে পুনরায় গারদখানায় নেওয়ার আগেই ঘটে ভয়ংকর ঘটনা। মুহূর্তের মধ্যেই হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া চার জঙ্গির দড়ির বাঁধন কেটে ফেলা হয়। চারজন একসঙ্গে দৌড়ে আদালত চত্বরের বিপরীত দিকের রঘুনাথ দাশ লেনের দিকে যেতে থাকে। এ সময় পুলিশ কনস্টেবলরা দৌড়ে তাদের আটকানোর চেষ্টা করেন। সঙ্গে আসামি পালিয়ে যাচ্ছে বলে চিৎকারও করেন। সড়কের মাঝখানের আইল্যান্ডে মাটিতে পড়ে যান এক পুলিশ সদস্য। তাকে জঙ্গিরা এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি মারে। পরে তারা রঘুনাথ দাশ লেন দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় পিছু নেয় অন্য পুলিশ সদস্য ও সাধারণ মানুষ। তারা ওই লেনের ১৫ নম্বর কারকুনবাড়ী লেন বড় জামে মসজিদের সামনে থেকে সবুর ও আরাফাতকে ধরে ফেলেন। তবে আবু সিদ্দিক সোহেল ও মাইনুল হাসান শামীম পালিয়ে যায়।

এর মাধ্যমে পুনরাবৃত্তি ঘটল ত্রিশাল সেই চাঞ্চল্যকর জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার। গতকালের ঘটনার আগে ২০১৮ সালের ২ মার্চ সকালে ফিল্মি স্টাইলে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রকাশ্যে প্রিজন ভ্যানে গুলি চালিয়ে ও বোমা মেরে জঙ্গি হামলার দায়ের করা মামলার তিন আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, জঙ্গিরা একাধিক মোটরসাইকেল নিয়ে রঘুনাথ দাশ লেনে অপেক্ষা করছিল। তারা হাতকড়া কাটার জন্য একটি কাটার মেশিনও সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। পালিয়ে যাওয়ার সময় সেটি ফেলে গেছে। এ ছাড়া নিজেদের ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেলও ফেলে গেছে জঙ্গিরা। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, একটি লাল রঙের অ্যাপাচে ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলে করে তিনজনকে পালিয়ে যাচ্ছে। ওই মোটরসাইকেলে ছিল পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গি। তাদের ঠিক পেছনেই একজনকে ব্যাগ নিয়ে দৌড়াতে দেখা যায়।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দৌড়ে যাওয়া ব্যক্তির কাঁধে ব্যাগ ছিল। সে হয়তো কোনো বিস্ফোরক ব্যবহার করছিল। তবে পালাতে ব্যর্থ হওয়া দুই জঙ্গিও একটি মোটরসাইকেলে করে পালাতে চেয়েছিল। পরে সেখান থেকে একটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়। মোটরসাইকেলটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ঢাকা মেট্রো-ল-৩১-৫৭১০। বিআরটিএ সূত্রে এর মালিক হাসান আল মামুন। ঠিকানা ৮৫/১ ফায়দাবাদ। তবে কথা বলা হলে হাসান আল মামুন জানিয়েছেন, ২০২১ সালে তিনি মোটরসাইকেলটি বিক্রি করে দিয়েছেন। তবে ক্রেতা এখনো তার কাছ থেকে নাম পরিবর্তন করে নেননি। সংশ্লিষ্ট ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, আদালতের ফটকে জঙ্গিদের অন্য সহযোগীরা অপেক্ষমাণ ছিল। আরাফাত, সবুর, শামীম ও সোহেল ফটকের সামনে এলে অন্যরা পুলিশ সদস্য ও নিরাপত্তারক্ষীর দিকে পিপার স্প্রে ছোড়ে। এতে পুলিশ সদস্যরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লে সহযোগীরা শামীম ও সোহেলকে নিয়ে পালিয়ে যায়। ফটকের সামনে থাকা কয়েকজন সাধারণ মানুষের চোখে-মুখেও স্প্রে লাগে। আহত পুলিশ সদস্য হাসপাতালে : পিপার স্প্রের শিকার হন পুলিশের কনস্টেবল (কং/৫১৯৫) মো. নুরে আজাদ (৩৯)। প্রথমে তাকে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সেখান থেকে তাকে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। সেখানেই তিনি চিকিৎসাধীন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর