বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

দেশবাসীর মাথার মুকুটে নতুন পালক : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি সারা বিশ্বে মর্যাদা পেয়েছে। আজকে বাংলাদেশ এবং দেশের মানুষের মাথার মুকুটে আমরা আরেকটি নতুন অহংকারের পালক যুক্ত করলাম। আমরা এগিয়ে যাব দুর্বার গতিতে। বাঙালি এগিয়ে যাবে দুর্বার গতিতে। সব বাধা অতিক্রম করে গড়ে তুলব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ। গড়ে তুলব স্মার্ট বাংলাদেশ। গতকাল রাজধানীর উত্তরায় দেশের প্রথম মেট্রোরেলের উদ্বোধনের পর সুধীসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘হবে জয়’ কবিতার চরণ উদ্ধৃত করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘অসম সাহসে আমরা অসীম সম্ভাবনার পথে ছুটিয়া চলেছি, সময় কোথায় পিছে চাব কোন মতে!’ শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সাহসের সঙ্গে করোনা মোকাবিলা করেছি। নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করেছি। দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে আমরা এগিয়ে যাব। আওয়ামী লীগ সেই দল, যে দল নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেন। আমাদের এনে দিয়েছেন মহান স্বাধীনতা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশের মানুষের উন্নয়ন হয়, আজ এটা প্রমাণিত সত্য। আবারও প্রমাণ হলো।

প্রযুক্তিতে চার মাইলফলক ছুঁয়েছে বাংলাদেশ : প্রধানমন্ত্রী বলেন, ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬ বা বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেলের উদ্বোধন ঢাকাবাসীর বহুপ্রতীক্ষিত স্বপ্ন। এমআরটি লাইন-৬-এর উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের শুভ উদ্বোধনের মাধ্যমে আজ মহানগরবাসীর সেই স্বপ্ন পূরণ হলো। মেট্রোরেল উদ্বোধনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, মেট্রোরেলের উদ্বোধনের ফলে একই সঙ্গে প্রযুক্তিতে চারটি মাইলফলক ছুঁয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমত, মেট্রোরেল নিজেই একটি মাইলফলক। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ প্রথম বৈদ্যুতিক যানের যুগে প্রবেশ করল। তৃতীয়ত, মেট্রোরেল রিমোট কন্ট্রোল যান। ডিজিটাল পদ্ধতিতে যেটি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি ধাপ। চতুর্থত, বাংলাদেশ দ্রুতগতিসম্পন্ন যানের যুগে প্রবেশ করল। মেট্রোরেলে সর্বোচ্চ গতি হবে ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকা মহানগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসন ও পরিবেশ উন্নয়নে মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। বর্তমান সরকার সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ছয়টি মেট্রোরেল লাইনের সমন্বয়ে সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা-২০৩০ নিয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) প্রতিষ্ঠা করেছি। এর আওতায় চারটি মেট্রোরেল লাইনের নির্মাণ বিভিন্ন পর্যায়ে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। দুটি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

ব্যবহারে যত্নবান হবেন : প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবার জন্য মেট্রোরেল’- এ স্লোগানে ঢাকা মেট্রোরেলে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য উন্নত বিশ্বের মতো প্রয়োজনীয় সব সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মেট্রোরেলে নারী যাত্রীদের নিরাপদ ও স্বচ্ছন্দ যাতায়াত নিশ্চিতের জন্য প্রতিটি মেট্রো ট্রেনে একটি স্বতন্ত্র নারী কোচ রাখা হয়েছে। প্রতি মেট্রো ট্রেনে নারীদের জন্য আলাদা বগি থাকবে, আলাদা ওয়াশরুম থাকবে। বাচ্চাদের পরিচর্যা করার সুযোগ থাকবে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা মেট্রোরেলে পুরোপুরি ফ্রি চলাচল করতে পারবেন। মেট্রোরেল ব্যবহারে সবাইকে যত্নবান হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, অনেক টাকা খরচ করে মেট্রোরেল করা হয়েছে। এটা সংরক্ষণ করা, মান নিশ্চিত করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ব্যবহারকারীদের দায়িত্ব। ডিজিটাল ডিভাইস যেন নষ্ট না হয়, ব্যবহারের ক্ষেত্রে যত্নবান হবেন। কেউ যেন আবর্জনা না ফেলে, খেয়াল রাখবেন। শেখ হাসিনা বলেন, ঢাকা মহানগরবাসী ও অংশীজনের সর্বাত্মক সহযোগিতা ছাড়া মেট্রোরেল নির্মাণ একটি দুরূহ কাজ ছিল। একটি সুন্দর মহানগরী বিনির্মাণে তাদের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, মেট্রোরেল লাইনের নির্মাণকাজের সময় দুই পাশের বাসিন্দা, ব্যবসায়ীসহ জনগণকে খুব ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে, কষ্ট হয়েছে। এখন সেই কষ্ট শেষ। করোনার বৈশ্বিক মহামারি পরিস্থিতিতেও নির্ধারিত সময়ের আগে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের উদ্বোধন করতে পারলাম। সরকার, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা, টিম ডিএমটিসিএল, প্রকল্প কর্তৃপক্ষ, নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একীভূত প্রচেষ্টার ফসল। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এটা সম্ভব হয়েছে। মেট্রোরেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত জাপানি নাগরিককে স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ের ওই ঘটনার পর মেট্রোরেলের কাজ পুনরায় চালু করার পেছনে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের যে ভূমিকা, তা-ও স্মরণ করেছেন শেখ হাসিনা। জাপানি নাগরিকদের স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মাণের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের স্মৃতি যেন স্মরণে থাকে, আমরা সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

আমরা স্মার্ট জনশক্তি গড়ে তুলব : আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, যে-কোনো কাজ করতে গেলে সাহস ও সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়। আওয়ামী লীগ সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। যে কারণে মাত্র ১৪ বছরের মধ্যে দেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। এটা ধরে রেখে সামনে এগোতে হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উন্নত-সমৃদ্ধ। আমরা ২০২১-৪১ পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা নিয়েছি। ২১০০ সাল পর্যন্ত ডেল্টা পরিকল্পনা নিয়েছি। গবেষণার মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। অর্থনীতি মজবুত করেছি। মেট্রোরেল চালুর ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে জানিয়ে তিনি বলেন, মেট্রোরেলের কারণে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারিত হবে। দৈনিক যাতায়াতের যে সময় নষ্ট হয়, টাকাপয়সা নষ্ট হয় তা আর হবে না। আধুনিক পরিবহনব্যবস্থা হবে এই মেট্রোরেল। মেট্রোরেল পরিচালনায় চার গুণ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আমরা স্মার্ট জনশক্তি গড়ে তুলব। প্রধান অতিথির বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রীর হাতে মেট্রোরেলের রেপ্লিকা তুলে দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। অনুষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রী একটি স্মারক ডাকটিকিট এবং একটি ৫০ টাকার স্মারক নোট অবমুক্ত করেন। পরে মেট্রোরেল-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ফটোসেশন করেন প্রধানমন্ত্রী। সুধীসমাবেশে অংশগ্রহণ শেষে প্রধানমন্ত্রী প্রথম যাত্রী হিসেবে টিকিট কেটে মেট্রোরেলের দিয়াবাড়ী স্টেশনে প্রবেশ করেন। প্রধানমন্ত্রী মেট্রোরেলে দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও যান। যাত্রী নিয়ে এটিই মেট্রোরেলের প্রথম যাত্রা। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ট্রেনে যাত্রী হিসেবে ছিলেন তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা, আমন্ত্রিত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এর আগে বেলা ১১টা ৫ মিনিটে রাজধানীর উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের সি-১ ব্লকের খেলার মাঠে মেট্রোরেলের উত্তর স্টেশনের প্ল্যাটফরমে ফলক উšে§াচন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা ও প্রধানমন্ত্রীর বোন শেখ রেহানা এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। এরপর মেট্রোরেল উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সুধীসমাবেশে যোগ দেন তাঁরা। এ সময় মূল মঞ্চে তাঁদের সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী, ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি, জাইকার বাংলাদেশের প্রতিনিধি ইচিগুচি তমুহিদে, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) এমডি এম এ এন সিদ্দিক প্রমুখ। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন পর্যায়ের পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি, কূটনীতিকসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানজুড়ে মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গেছে। নেতা-কর্মীরা মুখরিত ছিলেন নানা ধরনের স্লোগানে।

সর্বশেষ খবর