মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

টানাপোড়েনের অবসান বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে

নিজস্ব প্রতিবেদক

টানাপোড়েনের অবসান বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গতকাল সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবাগ - পিআইডি

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বিশ্বব্যাংকের নাম আসে সবার আগে। সংস্থাটি বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে এগিয়ে আসে। এর অংশ হিসেবে স্বাধীনতার মাত্র এক মাস পরই ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সফরে আসেন বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রাবর্ট ম্যাক নামারা। সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং সেদিন থেকেই উন্নয়নের অংশীদার হয়ে যায়। এদিকে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের ৫০ বছরপূর্তিতে ঢাকা সফরে এসেছেন সংস্থাটির এমডি অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবাগ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার হতে পেরে আমরা গর্বিত।

অন্যদিকে ২০১১ সালে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। সে জটিলতার কারণে গত এক দশকের বেশি সময় সংস্থাটির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়। নিয়মিত কিছু খাতের উন্নয়নে ঋণ, সহায়তা প্রদান ছাড়া বড় কোনো অবকাঠামো নির্মাণে ঋণ দেয়নি এ সময়ে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরুর পর বাংলাদেশও সংস্থাটির পেছনে আর ধরনা দেয়নি। যদিও কানাডার আদালতে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হওয়া মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তলাবিহীন ঝুড়ির তকমাকে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এর আগে ১৯৯৪ সালে যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে ঋণ সহায়তা দেয় সংস্থাটি। যা ওই সময়ে ছিল সবচেয়ে বৃহৎ প্রকল্প।

দেশের দারিদ্র্যবিমোচন, গ্রামীণ রাস্তাঘাট নির্মাণ ও উন্নয়ন, মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, প্রযুক্তি, বিশেষ করে প্রাথমিক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা, আর্থিক খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বাজেট সহায়তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ঝুঁকি মোকাবিলাসহ সামগ্রিক উন্নয়নে ১৯৭২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৩৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ ও সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যা বাংলাদেশি মুদ্রার মূল্যমানে অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে প্রতি মার্কিন ডলারের মূল্য ১০৫ টাকা। যা ১৯৭২ সালে ছিল ১০ টাকার মতো। এমনকি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ডলার ও বাংলাদেশি টাকার বিনিময় মূল্য ছিল ৪০ টাকার নিচে।

এদিকে অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত আমরা বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৩৭ বিলিয়ন (৩ হাজার ৭০০ কোটি) মার্কিন ডলার ঋণ ও অনুদান সহায়তা পেয়েছি। এর মধ্যে ২৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন (২ হাজার ৬৬০ কোটি) ডলার অর্থছাড় করা হয়েছে। আমরা এ পর্যন্ত সুদ ও আসল মিলিয়ে ৬ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন (৬৩৬ কোটি) ডলার পরিশোধ করেছি। বিশ্বব্যাংক ২০২৩-২৭ অর্থবছরের জন্য কান্ট্রি পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক (সিপিএফ) প্রস্তুত করছে।

অন্যদিকে পদ্মা সেতু বহুমুখী সেতু থেকে অর্থায়ন তুলে নেওয়ার পর অবশ্য বিশ্বব্যাংক তাদের ভুলও স্বীকার করেছিল। পরবর্তীতে আবারও অর্থায়ন করতে চাইলে সরকার তাতে অসম্মতি জানায়। বহুল আলোচিত সেই পদ্মা সেতু ছয় মাস আগে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পদ্মা নদীর অপর দুই প্রান্তে টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। যা হবে যোগাযোগ খাতের আরেকটি বৃহৎ প্রকল্প। ওই প্রকল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে বিশ্বব্যাংক বলে জানিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সম্পর্ক ৫০ বছরের। এটা অবশ্যই একটা স্মরণীয় ঘটনা। কিন্তু এর শুরুটা ছিল কিছুটা তিক্ততার মধ্য দিয়ে। অবশ্য সেসব চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশই সফলতা দেখিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সহায়তা করে। এরপর পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের ঘটনায় সম্পর্কে বেশ টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়েছিল। দুই পক্ষই একে অপরকে নানাভাবে দোষারোপও করেছে সে সময়। ধীরে ধীরে সে সম্পর্ক আবারো স্বাভাবিক হয়েছে বলে প্রতীয়মান। আসলে বিশ্বব্যাংক যেমন অনেক বড় উন্নয়ন সহযোগী। তেমন বাংলাদেশের মতো দেশগুলোও তো তাদের এক ধরনের কার্যক্ষেত্র। বিশ্বব্যাংক সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ২৪ নভেম্বর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের একটি প্রকল্পে ৫ কোটি ডলার সহায়তা দেয়। এটিই বাংলাদেশকে সংস্থাটির প্রথম সহায়তা। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার পল্লী সড়ক নির্মাণ, ১ হাজার সাইক্লোন শেল্টার ও ৭০০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বড় অবকাঠামো বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু (যমুনা সেতু) এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (দুই লেন) নির্মাণে অর্থায়ন ছিল বিশ্বব্যাংকের। তবে সংস্থাটি সত্তরের দশকে মূলত পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন প্রকল্পেই বেশি অর্থায়ন করেছে। আশির দশকে কৃষি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে বিশ্বব্যাংক। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সংস্থাটি এ দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য খাত সংস্কারে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেয়। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় কয়েক দশক ধরে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি) বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া নারী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি এখন একটি সফল প্রকল্প। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় এক হাজারের বেশি সাইক্লোন শেল্টার বানানো হয়েছে সংস্থাটির অর্থায়নে। ৭০০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।

সম্প্রতি সংস্থাটির নতুন কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুলায়ে সেক ঢাকায় এসেই জানান, স্বাধীনতার পর উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে এত পরিমাণে ঋণ-অনুদান কোনো উন্নয়ন সহযোগী দেয়নি, যা মোট ঋণ-অনুদানের ২৩ শতাংশ। গড়ে এখন বছরে দুই থেকে আড়াই বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে সংস্থাটি। বাংলাদেশকে চলমান ৫৫টি প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংক ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শুধু তাই নয় এশিয়ার যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনেক ভালো বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের নবনিযুক্ত বাংলাদেশের প্রধান আবদুলায়ে সেক। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিশ্বব্যাকের কর্মসূচির ব্যাপ্তী বিশ্বজুড়েই। তারা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে ঋণ সহায়তা দিয়ে একদিকে বাণিজ্য করে অন্যদিকে তারা সেসব দেশের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখে।

বিশ্বব্যাংকসহ সংস্থাগুলোকে সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর : এদিকে কভিড-১৯ মহামারি, যুদ্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সহায়তা জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশনস্) অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ। সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। পরে প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আঘাত হেনেছে। বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং পরিবহন ব্যয় বাড়ার ফলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো বিপাকে পড়েছে। তিনি বলেন, কভিডের আঘাত করার আগে বাংলাদেশে ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল। করোনা আঘাত করার পর কিছুটা কমে যায়। এরপর আমরা আস্তে আস্তে উন্নতি করতে থাকি। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোকে প্রতিশ্রুতি পূরণের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের জন্য উন্নত দেশগুলো দায়ী। তাদের উচিত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা করা। কিন্তু তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রাখছে না।

নিজস্ব তহবিল থেকে উপকূলে সবুজ বেষ্টনী, টেকসই বাড়ি নির্মাণসহ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোকে বিভিন্ন সহায়তার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেন তিনি। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশনস্) অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ বলেন, বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামনে চ্যালেঞ্জ আছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এসব দেশকে নতুন প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে সহায়তা অব্যাহত রাখবে জানিয়ে অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ বলেন, ১৯৭২ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পাশে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। ঢাকা সফর সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, এই সফরের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিকে আরও শক্তিশালী করা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করেন অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ বলেন, বিগত সময়ে বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নয়ন অবিশ্বাস্য। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা, দারিদ্র্য মুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা। মানুষের জন্য অধিকতর উন্নত ও সুন্দর জীবন নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমরা সে স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করছি। প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. গওহর রিজভী, প্রধানমন্ত্রীর অ্যাম্বাসাডর অ্যাট লার্জ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, সিনিয়র অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর