মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
সম্মেলন শুরু আজ

শক্তিশালী উপজেলা পরিষদ চান ডিসিরা

উবায়দুল্লাহ বাদল

এক যুগ আগে উপজেলা পরিষদের অধীনে সরকারের ১৭টি দফতর হস্তান্তর সংক্রান্ত বিধিমালা সংশোধন হয়েছে। সাত বছর আগে উপজেলা পরিষদকে শক্তিশালী করতে অফিস আদেশ জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এত কিছুর পরও কাক্সিক্ষত ক্ষমতা পায়নি উপজেলা পরিষদ। ধুঁকে ধুঁকে চলছে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানটি। উপজেলা চেয়ারম্যানদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন’ বরাবর এ জন্য আমলাতন্ত্রকেই দায়ী মনে করে। কিন্তু এবার সেই উপজেলা পরিষদকে আরও শক্তিশালী করার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়ে ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক (ডিসি) ফারাহ গুল নিঝুম বলেছেন, ‘উপজেলা পরিষদে হস্তান্তরিত দফতরসমূহের সব উন্নয়ন প্রকল্প উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে।’ প্রস্তাবটি আজ মঙ্গলবার শুরু হওয়া তিন দিন্যাপী ডিসি সম্মেলনের স্থানীয় সরকার বিভাগের কার্য-অধিবেশনে আলোচনা হবে। ঝালকাঠির ডিসি তার প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন, বর্তমানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দকৃত কিছু বাজেট ছাড়া অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষেত্রে উপজেলা পরিষদের সরাসরি কর্তৃত্ব নেই। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের বিভিন্ন প্রকল্প উপজেলা পরিষদের নজরদারির বাইরে সরাসরি জেলা কার্যালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা অনেক ক্ষেত্রেই প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সম্পর্কিত নন। ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনসম্পৃক্ততা কমে যায়।

স্থানীয় সরকার বিভাগ সংশ্লিষ্টরা জানান, উপজেলা পরিষদের কাছে সরকারি ১৭টি দফতর হস্তান্তর উপজেলা চেয়ারম্যানরা চাইছেন ও দীর্ঘদিন আন্দোলন করছেন। কিন্তু সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব ও মাঠ প্রশাসনের অনীহায় এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানরা আদালতের দ্বারস্থ হলে উপজেলা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে আইনবিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জিল্লুর রহমান চৌধুরীর (বর্তমানে খুলনার বিভাগীয় কমিশনার) নেতৃত্বে একটি উপকমিটি গঠিত হয়। উপকমিটিকে দফতর হস্তান্তর সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের সুপারিশ দিতে বলা হয়। এ কমিটি উপজেলা পরিষদে হস্তান্তরের জন্য যেসব আদেশ-নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেগুলো ‘অস্পষ্ট’ ও ‘অসামঞ্জস্য’ উল্লেখ করে সেগুলো স্থগিত বা বাতিলের সুপারিশ করে। বিদ্যমান আইনের ২৪ ধারা অনুযায়ী এটা সম্ভব। একই সঙ্গে পরিবর্তিত সময়ের নিরিখে উপজেলা পরিষদ আইনে সংশোধনের সুপারিশ করেছে উপকমিটি। উপকমিটি বলেছে, উপজেলা চেয়ারম্যানরা আদালতে যে প্রতিকার চেয়েছেন তা বিদ্যমান আদেশ-নির্দেশ অনুযায়ী যৌক্তিক। উপজেলা আইন অনুযায়ী, ১৩টি মন্ত্রণালয়ের ১৭টি দফতরের ৩৯টি অফিস উপজেলা চেয়ারম্যানদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। এসব অফিসের ১৫০টির মতো কমিটি আছে, যার মধ্যে ১৪০টির সভাপতি হিসেবে ইউএনওরা দায়িত্ব পালন করছেন। সরকার নিজের নেওয়া সিদ্ধান্ত কেন প্রতিপালন করছে না, তা নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যানরা। ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত মেনে চলতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন। উপজেলার সংশ্লিষ্ট দফতরের কাগজপত্র ও নথি অনুমোদনের জন্য ইউএনওর মাধ্যমে উপজেলা চেয়ারম্যানদের কাছে উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে আদালতের আদেশেও।

ডিসির প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন অর রশীদ হাওলাদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রস্তাবটি অত্যন্ত ইতিবাচক। সাংবিধানিক নির্দেশনারই প্রতিফলন। তাদের ইতিবাচক মনোভাব থাকলেই কেবল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হতে পারে। আমরা এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই।’

ডিসিদের পাঠানো স্থানীয় সরকার বিভাগের ৯টির মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবগুলো হলো- পঞ্চগড়ের ডিসি মো. জহুরুল ইসলাম প্রস্তাব করেছেন, দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য উপজেলা পরিষদের রাজস্ব তহবিলের ব্যয়সীমা ৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১০ লাখ টাকা করা প্রয়োজন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকাকে ব্যয়বহুল এলাকা ঘোষণার প্রস্তাব করেছেন কুমিল্লার ডিসি মোহাম্মদ শামীম আলম। প্রতিটি উপজেলা পরিষদের চত্বরে গোডাউন নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছেন পঞ্চগড়ের ডিসি মো. জহুরুল ইসলাম। দেশের প্রতিটি পৌরসভায় একটি করে শেখ রাসেল শিশুপার্ক নির্মাণের কথা বলেছেন চাঁদপুরের ডিসি।

সুরক্ষা সেবা বিভাগ সংক্রান্ত ১১টি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন ডিসিরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-কারাগারে মাদকসেবী কয়েদিদের জন্য মাদক নিরাময় কেন্দ্র করার প্রস্তাব করেছেন জয়পুরহাটের ডিসি সালেহীন তানভীর গাজী। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের আওতায় নৌ-ফায়ার সার্ভিস স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছেন রাঙামাটির ডিসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীদের জন্য ফায়ার ওয়াকিটকি দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন বান্দরবানের ডিসি ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি। মাদারীপুরের ডিসি উপজেলা পর্যায়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা পদায়ন এবং তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন।

এ ছাড়া স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের মোট ৩৯টি প্রস্তাব রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-বরিশালে একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছেন বরিশালের ডিসি। তিনি নবনির্মিত ইউনিয়ন পর্যায়ে ১০ শয্যার মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের কার্যক্রম ও পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগের প্রস্তাবও করেছেন। বরগুনার ডিসি বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের নবনির্মিত ভবন চালুর প্রস্তাব দিয়েছেন। ঝালকাঠির ডিসি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর জনবল কাঠামো আধুনিকীরণ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। ময়মনসিংহের ডিসি সেখানে ঔষধাগার নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছেন। মেলান্দহে একটি ট্রমা সেন্টার স্থাপনের প্রস্তাব করেছেন জামালপুরের ডিসি। গাজীপুরের ডিসি কমিউনিটি ক্লিনিকে টেলি মেডিসিন কার্যক্রম চালুর প্রস্তাব দিয়েছেন। নরসিংদীতে একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছেন সেখানকার ডিসি। পাশাপাশি তিনি একটি ট্রমা সেন্টার স্থাপনের কথাও প্রস্তাব করেছেন। জয়পুরহাটের ডিসি মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন সংশোধন করার প্রস্তাব করেছেন। ঠাকুরগাঁওয়ের ডিসি সেখানে একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করার প্রস্তাব করেছেন। চাঁদপুরের ডিসি কামরুল হাসান প্রস্তাব করেছেন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের একই কর্মস্থলে পাঁচ বছরের বেশি না রেখে একই বিভাগে বদলি করা।

সম্মেলন উদ্বোধন আজ  : জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন শুরু হচ্ছে আজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলন শেষ হবে ২৬ জানুয়ারি। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দুই বছর ডিসি সম্মেলন হয়নি। এরপর গত বছর ১৮-২০ জানুয়ারি ডিসি সম্মেলন হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি ওই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। তবে এবার সরাসরি উপস্থিত হয়ে ডিসি সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে তিনি সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন। গত বছরের মতো এবারও ডিসি সম্মেলনের মূল ভেন্যু রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন। সরকারের নীতিনির্ধারক ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে সামনাসামনি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতে প্রতি বছর ডিসি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সর্বশেষ খবর