বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
৪৭০ কোটি ডলার ঋণ

আইএমএফ যেসব সংস্কারের কথা বলল

নিজস্ব প্রতিবেদক

চলমান বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এই ঋণের প্রথম কিস্তি ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পাওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। মোট সাত কিস্তিতে এই ঋণ পাবে বাংলাদেশ। ঋণের প্রথম কিস্তির পরিমাণ হবে ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। অবশিষ্ট ছয় কিস্তির প্রতিটিতে ৭০ কোটি ৪ লাখ ডলার করে ঋণ ছাড় করা হবে। ঋণের শেষ কিস্তি আসবে ২০২৬ সালে। বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে, ঋণের গড় সুদ হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। গত সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় অনুষ্ঠিত আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকে এ ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়।

আইএমএফ এ ঋণ অনুমোদনের বিষয়ে গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে তাদের ওয়েবসাইটে। সেখানে কতগুলো সংস্কারের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, আইএমএফের শর্তগুলো বুঝতে আরও কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হবে। তবে আমরা শুধু কিছু টাকা পাব। অতি সম্প্রতি ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের মতো ছাড় হবে।  মোটাদাগে তারা যে সংস্কারগুলোর কথা বলেছে তা হচ্ছে- সরকারের ব্যয় কমাতে হবে, আর্থিক খাত সংস্কার করতে হবে, জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে, ঋণখেলাপি কমাতে হবে প্রভৃতি। এখানে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলো কী সেটা এখনো আমরা জানি না। তাদের এই ঋণ মূলত ৪২ মাস তথা ২০২৬ সাল পর্যন্ত চলমান থাকবে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ আইএমএফের ঋণ পাচ্ছে তার মানে দাঁড়াচ্ছে দেশের আর্থিক দুর্বলতা দূর হয়ে এর ভিত্তি মজবুত হয়েছে। বিদেশি বড় ব্যাংক এখন বাংলাদেশকে আরও ভালো চোখে দেখবে, কারণ বাংলাদেশ আইএমএফের একটা কর্মসূচির মধ্যে আছে। এখন সেই ব্যাংক একটা ঋণপত্র খুলতে কোনো ধরনের দ্বিধাবোধ করবে না। সূত্র জানিয়েছে, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল চিকিৎসার জন্য এখন সিঙ্গাপুর অবস্থান করছেন। দেশে ফিরে আগামী বৃহস্পতি বা শুক্রবার আইএমএফের ঋণ নিয়ে ব্রিফিং করতে পারেন। আইএমএফের বিভিন্ন শর্ত সম্পর্কে অর্থ বিভাগের ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রথম কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো পূর্বশর্ত নেই।

সরকার এখন জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছে নিজের প্রয়োজনে। মূলত প্রথম কিস্তি পেতে কোনো পূর্বশর্ত নেই। গতকাল বিদ্যুতের দাম যে বাড়ানো হয়েছে এর সঙ্গে প্রথম কিস্তির ঋণের কোনো সম্পর্ক নেই।

অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, আইএমএফের বাংলাদেশের ঋণের অনুমোদনের ছয়টি বিষয় ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে আইএমএফের  বোর্ড অনুমোদনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচ কার্যদিবস লাগবে। সেটা বাংলাদেশে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে সাত দিন সময় লাগবে। অনুমোদনের ঋণ প্রস্তাবের ছয়টি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে- আইএমএফের স্টাফ মিশনের মূল্যায়ন, ঋণের ব্যাক গ্রাউন্ড নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের চিঠি, মেমোরেন্ডাম অব ইকোনমিক অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল পলিসির মধ্যে থাকবে নানা ধরনের সরকারের প্রতিশ্রুতিগুলোও।

আইএমএফ বলেছে, আর্থিক খাতের শাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সার্বিক ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি স্থাপন এবং বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াসহ প্রায় বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে এই ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে ঋণের যে কোনো কিস্তি আটকে দিতে পারে আইএমএফ। এই ঋণের মধ্যে ‘বর্ধিত ঋণ সুবিধা’ (ইসিএফ) ও ‘এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি’ (ইএফএফ)-এর অধীনে প্রায় ৩৩০ কোটি ডলার এবং নবগঠিত ‘রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি’ (আরএসএফ)-এর অধীনে অবশিষ্ট ১৪০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। এ ফান্ড থেকে এশিয়ার কোনো দেশ এই প্রথম অর্থ পাচ্ছে।

গতকাল এক বিবৃতিতে আইএমএফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তনি মনসিও সায়েহ বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা করতে পিছিয়ে পড়া মানুষদের সুরক্ষা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সবুজ প্রবৃদ্ধিতে উৎসাহিত করতে এ ঋণ ব্যবহার করা হবে। বৃহত্তর সামাজিক ও উন্নয়নমূলক ব্যয় সক্ষম করার জন্য আর্থিক খাত তৈরিতে ফোকাস করবে আইএমএফ ঋণ। আর্থিক খাত উন্নত ও শক্তিশালীকরণ, নীতি কাঠামো আধুনিকীকরণ এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা তৈরিতে সহায়তা করবে এ ঋণ। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে আরও টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সরকারকে তার উচ্চাভিলাষী সংস্কার কার্যক্রমের গতি বাড়াতে হবে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হতে গেলে মানবসম্পদ ও অবকাঠামো খাতে আরও বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনেও তা জরুরি। বাংলাদেশ সরকার এসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও বাংলাদেশ অবগত।

মনসিও সায়েহ বলেন, রাজস্ব খাতে সংস্কার করলে বাংলাদেশ সামাজিক খাত, উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যয় বৃদ্ধি করতে পারবে। তবে সে জন্য কর নীতি ও রাজস্ব প্রশাসন উভয় খাতেই হাত দিতে হবে। রাজস্ব সংস্কার হলে সরকারি অর্থায়ন, বিনিয়োগ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে। এতে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে এবং শাসনব্যবস্থা উন্নত হবে। আর্থিক খাতের দুর্বলতা কমলে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উন্নত করা হলে ও পুঁজিবাজারের উন্নতি করা গেলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করা সম্ভব হবে।

সর্বশেষ খবর