রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ফিরে আসার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রত্যাবাসন ইস্যুতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ক্যাম্পে প্রত্যাবাসন সমর্থিত ও প্রত্যাবাসনে অনাগ্রহীদের মধ্যে এ নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক চলছে। বেশির ভাগ রোহিঙ্গার দাবি, প্রত্যাবাসন ছাড়া রোহিঙ্গাদের ভিন্ন পথ অবলম্বনের কোনো সুযোগ নেই।
গত শুক্রবার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য দেখে এসে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের সদস্যদের বক্তব্য প্রসঙ্গে সাধারণ রোহিঙ্গারা বলছেন, তারা যে বক্তব্য মিডিয়ায় উপস্থাপন করেছেন, সেটি তাদের একান্ত ব্যক্তিগত হতে পারে। তাই বলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ হবে, সেটি মেনে নেওয়া যায় না। প্রত্যাবাসন রোহিঙ্গাদের অধিকার। কারও ভালো লাগলে যাবে, কারও ইচ্ছা হলে যাবে না, তাই বলে সব রোহিঙ্গা যাবে না এমন নয়। গতকাল উখিয়া ও টেকনাফের একাধিক রোহিঙ্গা নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিনিধি দল যাই বলুক বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দুই দেশের সরকার চাইলে রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসিত হবেন। দাবি আদায়ের বিষয়েও তাদের বক্তব্য স্পষ্ট। তারা বলছেন, আগে মিয়ানমারে রাখাইনের মাটি ধরি, তারপর যত দাবি সেখান থেকেই দেব। জন্মভূমিতে দাঁড়িয়ে অধিকার আদায় রোহিঙ্গাদের জন্য অনেক বেশি সহজ হবে। টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নাগরিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেশের জন্য অনেক বেশি মন জ্বলে। সেখানে মা, বাবা কত আত্মীয়স্বজনের কবর। এখানেও তো আমাদের কোনো অধিকার নেই, এমনি ভাসমান জীবনে কোনোমতে বেঁচে আছি। তার চেয়ে জন্মভূমিতে মরার সুখ অনেক বেশি। কেউ যাবে না যাবে সেটি আমাদের দেখার বিষয় নয়, আমাদের ডাকলে আমরা মিয়ানমার ফিরবই।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, সবেমাত্র রোহিঙ্গাসহ আমরা মিয়ানমারের মংডু ও এর আশপাশে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রস্তুতকৃত গ্রাম ও অবকাঠামো দেখে আসলাম। দুই দেশের মধ্যে আরও আলোচনা হবে, আশা করছি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অগ্রগতি হবে।
উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দাবি আদায়ের জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প নয়, মিয়ানমারের আরাকানই আমাদের জন্য আসল জায়গা। যারা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও ভিটাজমির কথা বলছেন, তারা আসলে রোহিঙ্গাদের কথা ভাবছেন না। বাংলাদেশেও তো আমাদের কোনো নাগরিকত্ব নেই, ভিটাজমি নেই। এক সময় নিরাপত্তা যেটি ছিল রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী দ্বারা সেটিও এখন নেই। তাহলে এদেশে যদি আমরা এসব কিছু ছাড়া থাকতে পারি, তাহলে জন্মভূমি মিয়ানমারে কেন নয়? তিনি আরও বলেন, মিয়ানমার প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। কারণ তাদের ওপর পুরো দুনিয়ার চোখ থাকবে। সেখানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে গিয়ে কোনো অন্যায় করলে সেটি ইন্টারনেটের বদৌলতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে ক্যাম্পে কোনো রোহিঙ্গাই নিরাপদ নয়। প্রতিটি ক্যাম্পে তৈরি হয়েছে আলাদা আলাদা দুষ্কৃতকারী গোষ্ঠী। এখানেই রোহিঙ্গারা সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ক্যাম্পে এখন প্রাণের নিশ্চয়তা নেই, কে কোন দিক থেকে এসে গুলি করে পালিয়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে দেশে গিয়ে জন্মভূমির স্বাদ নিতে পারলে অনেক বেশি সুখ।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে ৮ লাখ ৬২ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা দেওয়া হয়েছিল। মিয়ানমার ওই তালিকায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করতে প্রাথমিক বাছাই করে। এর মধ্যে প্রথম দফায় ১ হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার পাইলট প্রোগ্রাম হাতে নেই। ওই তালিকার রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাইয়ে গত ১৫ মার্চ মিয়ানমারের ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসেন। তারা প্রত্যাবাসনের পাইলট প্রকল্পে তালিকাভুক্তদের মধ্যে ৪৮০ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই শেষে ফিরে যান। এরপর গত শুক্রবার ২০ জন রোহিঙ্গাসহ ২৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল মিয়ানমার রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনে যায়। তারা সেখানকার পরিবেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের উপযোগী কি না যাচাই করেন। দেশে ফিরে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমান মিয়ানমারের সদিচ্ছার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও মো. সেলিম ও সুফিয়ান নামের প্রতিনিধি দলের দুই সদস্য সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে দাবি আদায়ের আগে সেখানে ফিরবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন। তবে তাদের এ বক্তব্যে প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত হবে না বলে জানিয়েছেন আরআরআরসি।