সোমবার, ৮ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য নাকি কৌশল

পাঁচ সিটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপি

শফিউল আলম দোলন ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ

কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য নাকি কৌশল

আসন্ন পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও কাউন্সিলর পদে অংশ নিচ্ছেন দলের অনেকেই। দলীয় প্রতীক না থাকায় কাউন্সিলর পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াচ্ছেন তারা। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রচারণাও শুরু করে দিয়েছেন অনেকে। একইভাবে মেয়র পদে প্রার্থী হলে বহিষ্কারের ঝুঁকি থাকলেও এ পদে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করছেন অনেকে। তারা আন্দোলনের অংশ হিসেবেই সিটি নির্বাচনে অংশ নিতে চান। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল বিএনপির নেতা-কর্মীদের মাঝে এক ধরনের টানাপোড়েন চলছে।  তবে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে কেন্দ্রকে অযথা কঠোর না হওয়ার বিষয়েও পরামর্শ দিচ্ছেন অনেকে। এ নিয়ে যাতে দলে কোন্দল অধিক মাত্রায় মাথাচাড়া দিয়ে না উঠে সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দলীয় সিদ্ধান্ত আমরা পরিষ্কার করেছি। জানিয়ে দিয়েছি ১০ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই সরকারের অধীনে বিএনপি কোনো ভোটেই অংশ নেবে না। আমাদের মূল ফোকাস এখন আন্দোলনে। তাই যদি কেউ দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সিটি ভোটে অংশ নেয়-তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর মাধ্যমে জানা গেছে, আসন্ন সিলেট সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য ও বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। আগামী ২০ মে সমাবেশ করে প্রার্থিতার বিষয়টি স্পষ্ট করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন সরকার শাহনূর ইসলাম রনি। তিনি কারান্তরিন বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারের ছেলে। রনি দলের কোনো পদে নেই। খুলনা সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আগ্রহী মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু। তিনিও পরোক্ষভাবে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বরিশাল সিটিতে ভোট করার ঘোষণা দিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছেন সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে কামরুল আহসান রূপন। তার বাবা বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি। ২০১৩-১৮ মেয়াদে বিএনপির হয়ে মেয়র পদে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন তিনি। বাবার অনুসারীদের ‘সহানুভূতি’ ছাড়াও দলের নেতা-কর্মীদের একটি অংশের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন বলে দাবি করেছেন সাবেক ছাত্রদল নেতা রূপন।

অন্যদিকে রাজশাহীতে মেয়র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা নাদিম মোস্তফার ভাই সাবেক ছাত্রদল নেতা সাঈদ হাসান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি প্রার্থী হতে আগ্রহী। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। দুই তিন দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত জানাব। এ ছাড়া সাবেক মেয়র প্রার্থী বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, রাজশাহী মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ও নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি জাকির হোসেন রিমনও ভিতরে ভিতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়ে দলের মহাসচিবসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতাদের শক্ত অবস্থান ও কঠোর হুঁশিয়ারির মধ্যেই বিএনপি ঘরানার প্রার্থীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের অনেকের দাবি, দল থেকে ‘মৌন সমর্থন’ নিয়েই তারা প্রার্থী হচ্ছেন। ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য দলের কোনো চাপ আসছে কি না জানতে চাইলে গাজীপুর সিটিতে বিএনপি সমর্থক সরকার শাহনূর ইসলাম মেয়র প্রার্থীসহ বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থী বলেছেন, কোনো চাপ এখন পর্যন্ত তারা পাননি। বরং আওয়ামী লীগ যাতে নির্বাচনের ফাঁকা মাঠে গোল দিতে না পারে- সেই মতামতও ব্যক্ত করেছেন দলের অনেক নেতা-কর্মী।

খুলনা বিএনপির নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জু এ বিষয়ে বলেন, আন্দোলন ও নির্বাচন দুটিতেই বিএনপির থাকা উচিত। তাছাড়া তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে ভোটে অংশ নেওয়া জরুরি। তা না হলে নেতা-কর্মীরা দলছুট হয়ে যায়। আন্দোলনে মাঠ দখলে রাখতেও ভোটের প্রচারণা কাজে দেবে। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন, এ প্রশ্নের জবাবে বরিশালের কামরুল আহসান রূপন বলেন, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মানদন্ড জনগণের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য-সেই বিষয়টি প্রমাণের জন্যই আমি নিজের ইচ্ছায় নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, ভোট নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম সিটি নির্বাচন সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আমাদের এখন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কাজ চলছে। স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিতে আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যেও কোনো টানাপোড়েন আছে বলে আমার মনে হয় না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মাধ্যমে জানা গেছে, আসন্ন পাঁচ সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন বিএনপির কয়েক শ নেতা। তাদের প্রত্যাশা- তারাই এই নির্বাচন জমিয়ে তুলবেন। কারণ ভোটের মাঠে নিঃসন্দেহে শক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছেন তারা। এদের মধ্যে কেউ কেউ টানা কয়েকবারের কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই কাউন্সিলর প্রার্থীরা বলছেন, বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচনে না গেলেও তারা নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখার জন্যই ভোটে অংশ নেবেন। তাদের এও বিশ্বাস, কেন্দ্র এ বিষয়ে কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। কারণ কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করতে দলীয় প্রতীক লাগে না। এখানে সবাই স্বতন্ত্র প্রার্থী। তাছাড়া শতাধিক সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থীও ভোটের মাঠে আছেন।

পাঁচ সিটিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির সবচেয়ে বেশি কাউন্সিলর প্রার্থী মাঠে আছেন সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচনে। তারা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য মাঠে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। ৪২টি ওয়ার্ডে কমপক্ষে শতাধিক নেতা প্রার্থী হওয়ার তালিকায় রয়েছেন। প্রতিটি ওয়ার্ডে দুই থেকে পাঁচজন পর্যন্ত প্রার্থী রয়েছেন। সিসিকে মোট ৪২টি ওয়ার্ড। বিএনপি দলীয় ৬ জন বর্তমান কাউন্সিলর রয়েছেন। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে (গাসিক) ৫৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে মহানগরের বিভিন্ন পদে থাকা বিএনপির ২৪ জন নেতা কাউন্সিলর প্রার্থী হয়ে ভোটের মাঠে আছেন। এদের মধ্যে আটজনই ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হন। তাদের প্রায় সবাই এবারও নির্বাচন করবেন। তাদের বক্তব্য, নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়া যাবে না- বিএনপির কেন্দ্র থেকে এমন কোনো সিদ্ধান্ত আছে বলে তাদের জানা নেই। এ বিষয়ে বর্তমান কাউন্সিলর মোহাম্মদ হান্নান মিয়া বলেন, আমি দ্বিতীয়বারের মতো কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন করছি। সাধারণ মানুষের ভালোবাসা ও চাহিদার কথা বিবেচনা করেই ভোট করতে হচ্ছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনে (রাসিক) মোট ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে অন্তত ২২টি ওয়ার্ডে বিএনপি নেতারা কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন। বর্তমানে তাদের দলীয় কাউন্সিলর আছেন আটজন। আর সংরক্ষিত দুজন। রাসিকের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য তাজউদ্দিন আহমেদ সেন্টু। রাসিকের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ২০০২ সাল থেকে টানা চারবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন শাহ মখদুম থানা যুবদলের সাবেক সভাপতি বেলাল আহমেদ। এবারও তিনি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে অন্তত ২৫টিতে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা কাউন্সিলর প্রার্থী হতে যাচ্ছেন। এর মধ্যে মহানগর বিএনপির অন্তত দুজন যুগ্ম আহ্বায়ক এবং বেশ কয়েকজন সদস্য রয়েছেন। আছেন অন্তত দুজন বর্তমান সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।

খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) ৩১টি ওয়ার্ডের মধ্যে বিএনপি দলীয় কাউন্সিলর আছেন ১৩ জন। আছেন একজন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরও। খুলনা সিটিতে এ পর্যন্ত ১৬১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে মেয়র পদে পাঁচজন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১২৬ জন এবং নারী সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩০ জন। এর মধ্যে কাউন্সিলর পদে কয়েক ডজন প্রার্থী রয়েছেন বিএনপির দলীয় নেতা-কর্মী। ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে টানা তিনবার বিজয়ী কাউন্সিলর আশফাকুর রহমান কাকন খুলনা মহানগর বিএনপির সদস্য। মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হাফিজুর রহমান ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে টানা দুবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি নির্বাচনের জন্য বেশ আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে তার থেকে জনপ্রিয় আর কোনো প্রার্থী নেই বলে দাবি হাফিজুরের।

পাঁচ সিটির বিভিন্ন ওয়ার্ডে দেখা গেছে, পাড়া-মহল্লাগুলোতে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত প্রার্থীরা পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানার ও বিলবোর্ড সাঁটিয়েছেন। তারা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ভোটারদের কাছে দোয়া চাচ্ছেন। অনেক প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর