বৃহস্পতিবার, ১১ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

সংকটে হৃদরোগ চিকিৎসা

♦ সরকারি হাসপাতালে ভাল্বের সংকট ♦ বেড়েছে স্টেন্টের দাম ♦ বিপাকে দরিদ্র রোগী ♦ বিদেশ যাওয়ার ভিড় বাড়ছে

জয়শ্রী ভাদুড়ী

সংকটে হৃদরোগ চিকিৎসা

সংকটে পড়েছে দেশের হৃদরোগ চিকিৎসা। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভাল্ব সংকটে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিস্থাপন। মিলছে না অক্সিজেনেটরও। ডলার সংকটে ব্যাংকে এলসি খুলতে না পারায় জীবন রক্ষাকারী এসব ডিভাইস আনতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা। এর মধ্যে স্টেন্টের (রিং) দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন হৃদরোগীরা।

সরকারি কেনাকাটা প্রক্রিয়ার জটিলতাও সংকটের আরেক কারণ। ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রায় নিয়মিতই চলছে ভাল্ব প্রতিস্থাপন, রিং পরানোসহ অন্যান্য সার্জারি। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের খরচ বহন করার সামর্থ্য নেই অনেক রোগীর। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল- সরকারি এ তিনটি প্রতিষ্ঠানেই ১০ মাস ধরে ভাল্ব ও অক্সিজেনেটর সংকট চলছে। শুরুতে মজুদকৃত ডিভাইসে সার্জারি চললেও আড়াই মাস ধরে তা-ও ফুরিয়ে এসেছে। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ঢিমেতালে চললেও অন্য দুই হাসপাতালে প্রায় বন্ধের পথেই। অক্সিজেনেটরের অবস্থাও একই। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভাল্বের কিছুটা সংকট এখনো রয়েছে, পুরোপুরি কাটেনি। আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহের চেষ্টা করছি। বেশ কিছু হাতে আছে, লিয়াজোঁ করে আরও কিছু সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে সরবরাহ এখনো কম। অন্য হাসপাতালগুলোও ডিভাইস নিয়ে সমস্যায় আছে। স্টেন্টের দাম ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে কিছুটা বাড়ানো হয়েছে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় আড়াই মাস ধরে ভাল্ব প্রতিস্থাপন ও বাইপাস সার্জারি বন্ধ রয়েছে। টেন্ডার জটিলতা, আমদানি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। জানা গেছে, ওয়ার্ক-অর্ডার হয়ে গেছে। শিগগিরই প্রয়োজনীয় ডিভাইস চলে আসবে হাসপাতালে। বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. রেজাউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, প্রযুক্তি থাকলেও ভাল্ব প্রতিস্থাপন বন্ধ রয়েছে এরকম একটা বিষয়ে মাসখানেক আগে চিঠি পেয়েছিলাম। আমি তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি উপাচার্য ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ওনারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। যতটুকু জানতে পেরেছি, ডলার সংকটের কারণে আমদানিকারকরা ঠিকমতো সরবরাহ করতে পারছেন না। আমি প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়ায় জড়িত না থাকায় আপডেট তথ্য জানাতে পারছি না।’ একই পরিস্থিতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও। হৃদরোগ চিকিৎসায় দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত রোগীদের ভরসার জায়গা এ তিন হাসপাতাল। ভাল্ব সংকটে মরণব্যাধি বুকে নিয়ে ঘুরছে মানুষ। জীবন বাঁচাতে অনেকে ঋণ করে, সম্পত্তি বিক্রি করে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভাল্ব আমদানিকারক বলেন, ‘ভাল্বসহ কোনো মেডিকেল ইকুপমেন্ট আমদানির জন্য আমরা এলসি খুলতে পারছি না।’ চুয়াডাঙ্গার আরিফ হোসেন (৩০) ছোটবেলা থেকে বাতজ্বরে ভুগছেন। গত বছর ঢাকায় চেকআপ করাতে এসে দেখা যায়, তার ভাল্ব নষ্ট হয়ে গেছে। চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন দ্রুত ভাল্ব প্রতিস্থাপনের। তিনি বলেন, ‘বাড়ি গিয়ে টাকা-পয়সা জোগাড় করে এনে মাসদুয়েক ধরে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে ঘুরছি। কিন্তু ভাল্ব নেই বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটেও প্রায় একই অবস্থা। আমদানিকারকের সঙ্গেও কথা বলেছি, তাদের কাছেও পাইনি। তাই ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ ভাল্ব সংকটের মধ্যে বেড়েছে স্টেন্টের দাম। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হৃদরোগে আক্রান্ত কিছু রোগীর রক্তনালি সরু বা বন্ধ (ব্লক) হয়ে যায়। এতে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। রক্ত চলাচল সচল রাখতে স্টেন্ট বা রিং ব্যবহার করা হয়। স্টেন্ট অনেকটা কালভার্টের মতো কাজ করে। গত ১ মার্চ থেকে জীবন রক্ষাকারী রিং ও পেস মেকারের দাম ২০-৩৫ শতাংশ বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর (ডিজিডিএ)। ডিজিডিএ সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করলে মেডিকেল ডিভাইস আমদানিতে স্থবিরতা নামে। এলসি জটিলতায় আটকে যায় বহু জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম। বিষয়টিকে সামনে রেখে চলতি বছরের শুরুতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ মেডিকেল ডিভাইস ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ডিলার্স অ্যান্ড ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। সেই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে জানুয়ারির শেষের দিকে প্রস্তাবের অনুমোদন দেয় ডিজিডিএ। নতুন দাম অনুযায়ী, এতদিন যে রিংয়ের দাম ছিল ৭২ হাজার টাকা, সেটি এখন নিতে হবে ৮২ হাজার টাকায়। একইভাবে ১ লাখ ৮ হাজার টাকার রিং ১ লাখ ৩৫ হাজার এবং দেড় লাখ টাকার রিং পেতে গুনতে হবে ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। আবার যে পেস মেকারের দাম এতদিন ৯৫ হাজার টাকা ছিল, এখন তা নিতে হবে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায়। ডিজিডিএর পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন বলেন, ‘সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ডলারের উচ্চমূল্যে বিষয়টিকে সামনে এনে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। যেহেতু সবকিছুর দাম বেড়েছে, তাই সব বিবেচনায় নিয়ে দাম বাড়ানোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর