রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (রামেবি) অনুমোদন পায় ২০১৭ সালে। এরপর অবকাঠামো নির্মাণে সরকার অর্থ বরাদ্দ দেয়। দুই দফা প্রধানমন্ত্রী অবকাঠামো নির্মাণকাজের উদ্বোধনও করেন। কিন্তু সাত বছরেও রামেবির স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের জমি অধিগ্রহণ করা যায়নি। এরই মধ্যে ৬০ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করেছে রামেবি কর্তৃপক্ষ।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি আহমদ শফিউদ্দিন বলেন, ‘জমি নেই; কিন্তু টেন্ডার আহ্বান করা হলো। সেই টাকার কাজ কোথায় করবে তারা? এই টাকা তাদের পকেটে নেওয়ার একটা নতুন কৌশল। দরপত্র প্রক্রিয়া বন্ধ করে এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
রামেবি সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে অনুমোদন পাওয়ার পর তৎকালীন উপাচার্য ডা. মাসুম হাবিব জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করেন। কিন্তু সেই জমি ব্যবহার উপযোগী করতে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হতো। ফলে সেখান থেকে সরে আসে কর্তৃপক্ষ। ২০১৮ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় জমির জন্য ব্যয়ও বাড়াতে হয়েছে। সংশোধনী ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। ফলে কাজ শুরুর আগেই ব্যয় বেড়েছে ৫৩৩ কোটি টাকা। তারপরও ভূমি অধিগ্রহণই সম্পন্ন করা যায়নি।
কিন্তু এরই মধ্যে অবকাঠামো নির্মাণকাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। নগরীর সিলিন্দা এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য নিয়োগ করা পরামর্শককে দিয়েই করানো হচ্ছে সব কাজ। বালু ভরাট, মাটি ভরাট, ফটক ও প্রাচীর নির্মাণ কাজের দরপত্রের সব কাজই করছেন পরামর্শক রেজায়াত হোসেন রিটু।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভূমি অধিগ্রহণের এক বছর আগেই পরামর্শক নিয়োগ দিয়ে প্রতি মাসে ২ লাখ ১ হাজার টাকা বেতন দিতে শুরু করে। নিয়ম অনুযায়ী ভূমি অধিগ্রহণের পরই পরামর্শক নিয়োগ দিতে হবে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়টির অবকাঠামো নির্মাণকাজ সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দেবেন সেই পরামর্শক। তিনি পর্যবেক্ষণ করবেন এবং প্রতিবেদন দেবেন। সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় নিযুক্ত প্রকৌশলীরা কাজ করবেন। তিনি কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত কোনো ফাইলেও স্বাক্ষর করতে পারবেন না। কিন্তু এসব নিয়ম লঙ্ঘন করে রামেবির নিয়োগ করা পরামর্শক রেজায়াত হোসেন রিটুকে দিয়েই সব কাজ করানো হচ্ছে।
রামেবি সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির অবকাঠামো নির্মাণকাজের অংশ হিসেবে ৬০ কোটি টাকার চারটি কাজের জন্য সম্প্রতি দরপত্র আহ্বান করা হয়। গত ৩ এপ্রিল সেই দরপত্র খোলা হয়। ওই দরপত্র আহ্বানের বিজ্ঞপ্তিতে স্বাক্ষর করেন রামেবি উপাচার্য ডা. এ জেড এম মোস্তাক হোসেন ও পরামর্শক রেজায়াত হোসেন রিটু। রিটুকে দিয়ে দরপত্র প্রস্তুত সম্পন্ন করার পরে ওপেনিং কমিটির সদস্যসচিব করা হয় তাকে। এমনকি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিরও সদস্যসচিব করা হয় তাকে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী একই ব্যক্তি দরপত্র খোলা ও মূল্যায়ন কমিটির দুটি কমিটির একই পদে থাকতে পারবেন না। আবার সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রকল্পের পরিচালক হতে হলেও তাকে চাকরির অন্তত তিন বছর মেয়াদ থাকতে হবে। সে নিয়ম লঙ্ঘন করে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য ডা. এ জেড এম মোস্তাক হোসেন নিজেই এই প্রকল্পের পরিচালক পদে বসেন। যদিও তার চাকরির মেয়াদ আছে আর মাত্র এক বছর সাত মাস।
রামেবির একাধিক সিন্ডিকেট সদস্য জনিয়েছেন, রেজায়াত হোসেন রিটুকে দরপত্র খোলা কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন উপাচার্য নিজেই। এরপর মূল্যায়ন কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে তাকে নিয়োগ দিতে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশও করেন তিনি। তার সুপারিশেই মূলত পরামর্শক রিটুকে মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিবও করা হয়। যা নিয়মের লঙ্ঘন।
রামেবির অবকাঠামো নির্মাণকাজের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুবার ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেছেন। কিন্তু এখনো কাজ শুরু করা হয়নি। সর্বশেষ গত বছরের ১৪ নভেম্বর এ বিশ্ববিদ্যালয়টির অবকাঠামো নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে ২০১৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবকাঠামো নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন।
রামেবি সূত্র মতে, ভূমি অধিগ্রহণের সময়সীমা ছিল গত বছরের ২৫ নভেম্বর। কিন্তু এখনো জমি বুঝিয়ে দিতে পারেনি রাজশাহী জেলা প্রশাসন। এর মধ্যে ৬৭ দশমিক ৬৭ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য শতকপ্রতি ১৭ লাখ টাকা করে জেলা প্রশাসন রামেবি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বুঝে নিয়েছে। এরই মধ্যে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ৬০ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদারদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
রামেবি সিন্ডিকেট সদস্য ও রাজশাহী-১ আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, ‘যেখানে জমিই নেই, সেখানে কাজ করবে কোথায়? এটি উপাচার্যের স্বেচ্ছাচারিতা ও অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কৌশল। আমরা নির্দিষ্ট ফোরামে এ নিয়ে কথা বলব। আমি ইতোমধ্যে টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ম অনুযায়ী হয়নি বলে মত দিয়েছি। তার পরও উনি যদি এটি করেন, তাহলে যে ফোরামে বললে এই অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হবে, সেখানে বলব।’
রামেবির পরামর্শক রেজায়াত হোসেন টিটু বলেন, ‘আমি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নই। আমার সঙ্গে যেসব বিষয়ে চুক্তি আছে, সেসব বিষয়ে আমি কাজ করছি। এর বাইরে ভিসি স্যারের অনুরোধে আমি টেন্ডার সংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করছি। এখানে আমার কিছু করার নাই।’
রামেবির উপাচার্য ডা. এ জেড এম মোস্তাক হোসেন বলেন, ‘পরামর্শকের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ীই তাকে দিয়ে টেন্ডারের কাজগুলো করানো হচ্ছে। এর জন্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতিও নেওয়া হয়েছে। কোনো অনিয়ম হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণ না হলেও অবকাঠামো তো ডিজাইন অনুযায়ী করা হবে। সেই কারণে আমরা কিছু কাজ এগিয়ে রাখছি। জমি বুঝে পেলেই যেন কাজ শুরু করা যায়।’
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        