এক দশকের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার অঘোষিত রাজা ছিলেন সাবেক এমপি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী। তিনি যা চাইতেন, কেবল তাই ঘটত উত্তর চট্টগ্রামের এই জনপদে। নির্বাচন, সরকারি দরপত্র, স্থানীয় রাজনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য- প্রতিটি সেক্টরেই ছিল তার একক আধিপত্য। চরম পরাক্রমশালী এই আওয়ামী লীগ নেতার মাথায় আর আগের সেই ‘মুকুট’ নেই। সরকার পতনের পর থেকে আর প্রকাশ্যেই আসেননি। গত বৃহস্পতিবার ভারতে পালাতে গিয়ে আখাউড়া সীমান্তে গ্রেপ্তার হন বিজিবির হাতে। ৫ আগস্টের পর থেকে এখনো পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে আটটি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর থেকে এটাকে তার নির্মম পরিণতি হিসেবে দেখছেন স্থানীয়রা। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিনের নির্যাতনের বিষয়ে মুখ খুলছেন অনেকে। জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির রাজনীতি করা ফজলে করিম ৫০ জনের একটি দল নিয়ে ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি করতেন। কয়েক বছর পর ওই দল থেকে পদত্যাগ করে এক প্রভাবশালী নেতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে দলটির মনোনয়ন পান। সেবার হেরে গেলেও ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে তিনি প্রথমবার রাউজানের এমপি হন। এর পর ২০০৮ থেকে পরের চারটি নির্বাচনেও তিনি এমপি হন।
ছিলেন বিনা ভোটের জাদুকর : ২০১৪ থেকে ২০২৪। ১০ বছরে রাউজানে দৃশ্যত কোনো নির্বাচন হয়নি। উপজেলা, পৌরসভা কিংবা ইউনিয়ন সব ভোটেই কেবল আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে নির্বাচিত হতেন জনপ্রতিনিধিরা। আর ফজলে করিম ছিলেন অঘোষিত নির্বাচন কমিশনার।
২০১৪ সালে বিনা ভোটে এমপি হন ফজলে করিম। এর পর থেকে বিনা ভোটের এই রীতি তিনি প্রতিটি স্থানীয় নির্বাচনে প্রয়োগ শুরু করেন। যে কোনো ভোটে, যে কোনো পদে তার কথার বাইরে কেউ মনোনয়ন কিনতে পারতেন না। ফলে প্রতিটি পদে একজনের বেশি প্রতিযোগী থাকত না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে একমাত্র প্রতিযোগী জয়ী হতেন। ২০১৪ সালে তৃতীয়বার এমপি হওয়ার পর থেকে রাউজানের সব স্তরের নির্বাচন তার নির্দেশনায় হতে শুরু করে। ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে ১৪ ইউনিয়নের মধ্যে ১১ জন চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্যসহ ১২২ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বাকি তিনটিতে নির্বাচন হলেও তার পছন্দের প্রার্থীরাই জয়ী হন। আর তার কথা না মেনে যারা প্রার্থী হন তারা পরবর্তীতে এলাকাছাড়া হন। ২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনেও ১৪ জন চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্যসহ ১৮২ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। একই বছরের পৌরসভা নির্বাচনেও ভোট ছাড়াই জিতেন রাউজান পৌরসভার মেয়র, ১২ জন কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলরা। ২০১৯ ও ২০২৪ সালে দুটি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও ফজলে করিমের নির্দেশনায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এর বাইরে গত তিনটি সংসদ নির্বাচনে ডামি প্রার্থী ছাড়া কেউ তার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি।
প্রতিপক্ষের জন্য ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক : বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, রাউজান উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফিরোজ আহমেদ, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সহসভাপতি সাবের সুলতান কাজলসহ বিএনপির অসংখ্য নেতা-কর্মী গত ১৫ বছরে নিজ এলাকা রাউজানে যেতে পারেননি। এলাকায় না গিয়েও করিমের নির্দেশে ডজন ডজন রাজনৈতিক মামলা নিয়ে ফেরারি হয়ে ছিলেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া ২০১৭ সালের মার্চে ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নুরুসহ বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বেশকিছু নেতা-কর্মীকে হত্যায় ফজলে করিমের প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ছিল বলে মনে করেন দলটির লোকজন। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সহসভাপতি সাবের সুলতান কাজল বলেন, ‘ফজলে করিম ও তার ক্যাডার বাহিনী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা নুরুল আলম নুরু, পৌরসভা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জয়নাল আবেদীন হান্নান, উপজেলা যুবদল নেতা আবুল হাশেম, প্রবাসী যুবদল নেতা মুসা, রাউজান থানা যুবদল নেতা রিয়াজ উদ্দিন ভুলুসহ অনেক নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে। অনেককে গুম করেছে।
সবার জন্য সমান অত্যাচারী : ফজলে করিম রাউজানে এমন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন যে তার কথার অবাধ্য হলে তিনি সবার জন্য সমান অত্যাচারী হয়ে উঠতেন। প্রতিপক্ষ দল হোক কিংবা নিজ দল, তার মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ ছিল না কারও। রাউজানে গত ১৫ বছরে বাস্তবায়িত চট্টগ্রাম-রাঙামাটি চার লেন সড়ক, হালদা নদীর বেড়িবাঁধ, বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক, ১৪ ইউনিয়নে পরিষদ কমপ্লেক্স, ২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, দুটি আবাসন প্রকল্প, থানা ভবনসহ অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকার সরকারি প্রকল্প থেকে ২০ শতাংশ কমিশন নিতেন বলে অভিযোগ আছে করিমের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া অন্যের জায়গায় বাগানবাড়ি তৈরি, সরকারি প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে কারসাজি, রেলওয়ের বিভিন্ন প্রকল্প থেকেও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।