যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার প্রভাব নিয়ে আলোচনা চলছে বিশ্বজুড়ে। বিশ্ব মোড়ল দেশটির নতুন নেতৃত্বে বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনীতি ও কূটনীতিতে কী পরিবর্তন আসবে তা নিয়ে প্রতিটি দেশই ভাবছে। একবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকা দেখা বিশ্বে বিশ্লেষণও চলছে নানামুখী। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার সম্পর্কে বড় ধরনের পরিবর্তন না এলেও গণতন্ত্র, সংখ্যালঘুদের অধিকার বিষয়ে সম্পর্কে কিছু পরিবর্তন আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, বাংলাদেশে একটা নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক করার তাগিদ থাকবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের। কেননা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের যে সম্পর্ক রয়েছে তা ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে নেই। সেই জায়গা থেকে দ্রুত নির্বাচনের জন্য আমেরিকার একটা তাগিদ থাকবে। ড. ইমতিয়াজ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে যেহেতু একটি অন্তর্বর্তী সরকার রয়েছে সেহেতু নির্বাচন নিয়ে ট্রাম্পের রিপাবলিকান প্রশাসন জোর দেবে। যদিও গত দুই সপ্তাহ ধরে বাইডেনের ডেমোক্র্যাট প্রশাসনও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে জানতে চেয়েছে। এ মুহূর্তে রিপাবলিকান প্রশাসন স্পষ্টত জানতে চাইবে বাংলাদেশে কবে নাগাদ নির্বাচন হবে।
তিনি আরও বলেন, এক এক্স বার্তায় ডোনাল্ড ট্রাম্প নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমার মনে হয়, ট্রাম্পের দিক থেকে ভারতকে কাছে টানার জন্য বড় ধরনের চেষ্টা থাকবে। কেননা জো বাইডেনের শাসনামলে ভারত অনেকটা চীন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। ভারত ইতোমধ্যে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে, পাশাপাশি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বড় একটা চেষ্টা তারা করেছে। যার জন্য রাশিয়া, চীন ও ভারত একটা কাঠামো তৈরি করে ফেলেছে। সেই জায়গায় আমেরিকার যে অস্বস্তি রয়েছে ট্রাম্প সেটা পরিবর্তন করার চেষ্টা করবেন। সেটা করতে গিয়ে বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব পড়বে তা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ অধ্যাপক আরও বলেন, ট্রাম্পের ওই এক্স বার্তায় সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে একটা বার্তা ছিল। সেটা কিন্তু ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এর আগে আওয়ামী শাসনামলে প্রিয়া সাহার ইস্যুতেও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছিল ট্রাম্প প্রশাসন। যদিও সে সময় অনেকে বলেছিল এ কাজটি বিরোধী দল করিয়েছে। তবে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ধারাবাহিকভাবে কথা বলেন। এটা এবার আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশে যেন কোনো ধরনের সংখ্যালঘু নির্যাতন না হয় সেদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের নজর থাকবে। তিনি বলেন, বড় আকারে আমেরিকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। বাংলাদেশের প্রতি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির যতটা উৎসাহ ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের ততটা উৎসাহ থাকবে বলে আমার মনে হয় না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে রিপাবলিকানরা বড় ধরনের কোনো চিন্তা-ভাবনা নাও করতে পারে। এক্ষেত্রে তারা পাশের দেশ মিয়ানমারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ইউক্রেন, গাজা, চীন, ভারতসহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলো সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে। আমেরিকার প্রভাব ঠিক রাখার ওপরই সবচেয়ে বেশি নজর দেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাতে করে বাংলাদেশের ওপর নজর অনেকটা কমে যেতে পারে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি মার্কিন রিয়েল এস্টেট ও অবকাঠামো খাত, বিশেষ করে শক্তি ও প্রযুক্তি খাতে চীনা বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। ট্রাম্প যদি এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করেন তাহলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। বাংলাদেশের জন্য তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে কিছুটা সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। কারণ আমাদের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবেন সেটাও দেখার বিষয়। তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জো বাইডেনের নীতির সঙ্গে খুব বড় ধরনের পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) আলোচনায় তারা কোনো কৌশলগত পরিবর্তন করবেন কি না সেটাও দেখতে হবে। কারণ ডেমোক্র্যাটরা টিকফা চুক্তির আওতায় শ্রম অধিকার, মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা করেছিল। যদিও তখন নির্বাচিত সরকার ছিল এগুলো নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আগামীতে সেটার কোনো পরিবর্তন হবে কি না দেখতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুদিন আগে করা ট্রাম্পের এক্স বার্তা বাংলাদেশের পক্ষে যায়নি, আবার বিপক্ষেও যায়নি। সুতরাং এটা এখনো নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক কোন দিকে নিয়ে যাবেন। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন উপলক্ষে গতকাল যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস আয়োজন করে ইলেকশন পার্টি। সেখানে উপস্থিত থাকা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের বলেছেন, বিভিন্ন কারণে এবারের মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল আমাদের সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক শুধু একটি দলের ওপর নির্ভর করে না। এখানে বহুবিধ কারণ রয়েছে, আমাদের বাণিজ্যিক, কৌশলগত, ভূ-রাজনৈতিকসহ অনেক বিষয় এখানে আছে। শুধু প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন হয়ে গেলেই এক দিনে এটা বদল হয়ে যায় না। সুতরাং এ ফলাফলে বাংলাদেশের জন্য খুব বেশি দুশ্চিন্তা নেই বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটির এই প্রধান।
একই রকমের মনোভাব প্রকাশ করেছেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অব্যাহতভাবে প্রায় আড়াই শ বছরের বেশি সময় ধরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকারিতা প্রদর্শন করেছে। আমরা একটা অপেক্ষাকৃত নতুন রাষ্ট্র, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। তাদের পদ্ধতি ও আমাদের পদ্ধতি ভিন্ন। আমাদের পার্লামেন্টারি সিস্টেম দুর্ভাগ্যবশত স্থিতিশীল হয়নি। তিনি বলেন, যদিও ট্রাম্প একটা টুইট করেছেন এবং এটি তাঁর ভোটের বিবেচনায় ভারতীয়দের ভোট পাওয়ার জন্য করেছেন। আমি নিশ্চিত ট্রাম্প বাংলাদেশ কোথায় সেটাও জানে না। আমার মনে হয় না এটার কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে।