উত্তাপ কমছে না ভারতে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার ইসকনের বহিষ্কৃত নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মুক্তি দাবিতে ভারতের বিভিন্ন মহল থেকে ছড়ানো হচ্ছে উত্তেজনা। দেওয়া হচ্ছে নানা হুমকিও। উদ্বেগ প্রকাশ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের দাবি করেছেন। ভারত ছাড়া বাংলাদেশ টিকতে পারবে না বলে হুমকি দিয়েছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ডা. মানিক সাহা। হামলার ঘটনা ঘটেছে ত্রিপুরায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ে। পেট্রাপোল সীমান্তে বিক্ষোভ করেছে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিরোধী দল নেতা শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে এই বিক্ষোভ হয়। এ সময় তিনি বাংলাদেশে আমদানি-রপ্তানি বন্ধের হুমকি দেন। সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত কোনো পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বিজেপি নেতা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন- ‘এটা আমরা ট্রেলার দেখলাম। এর পর আমরা পাঁচ দিন বাণিজ্য বন্ধ করব। আগামী বছর লাগাতার বাণিজ্য বন্ধ করে দেব। এর পর ওরা (বাংলাদেশিরা) কীভাবে আলু, পিঁয়াজ খায়, সেটা আমরা দেখিয়ে দেব।
কলকাতা প্রতিনিধি জানান, গতকাল কলকাতায় বিধানসভার অধিবেশনে বাংলাদেশের সম্প্রতি পরিস্থিতি নিয়ে ফের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিনি বলেন কোনো ধর্ম, বর্ণ, জাতি যে দেশের প্রান্তরেই হোক না কেন তারা যদি অত্যাচারিত হয়, আমরা তার নিন্দা করি। আমরা চাই সেখানে শান্তি ফিরে আসুক। আমরা চাই, প্রধানমন্ত্রী (ভারতের) দুই দেশের সঙ্গে কথা বলুন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীও কথা বলুন। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকার যেন জাতিসংঘে বিষয়টি জানায়। যাতে শান্তিরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশে মোতায়েন করা হয়।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন ‘এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। যা আমাদের সবাইকে আঘাত দিচ্ছে, দুঃখও দিচ্ছে। আমরা যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় আছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক যে ঘটনাগুলো ঘটছে, আমি এসব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করব না। কারণ বাংলাদেশ একটা অন্য রাষ্ট্র। এটি আমার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। এটি কেন্দ্রীয় সরকার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। এদিকে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. মানিক সাহা বলেছেন, ভারত ছাড়া বাংলাদেশ টিকতে পারবে না। রবিবার আগরতলায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, হিন্দু সংখ্যালঘুরা সে দেশে নৃশংসতার শিকার হচ্ছে- এটি একেবারেই উচিত নয়। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অতি সতর্কতা প্রয়োজন। আমাদের ভুয়া খবর এড়িয়ে চলাই ভালো এবং সব তথ্য যাচাই করা উচিত। ডা. সাহা বলেন, আমরা বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ এবং অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসসহ অনেক কিছু সরবরাহ করে থাকি। বাংলাদেশ থেকেও পণ্য আসে। আগরতলা এবং বাংলাদেশের মধ্যে ট্রেন পরিষেবা, মৈত্রী সেতু এবং অন্যান্য প্রকল্পগুলো ব্যাহত হয়েছে। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ভারত ছাড়া বাংলাদেশ কোনোভাবেই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না। বিষয়টি তাদেরও ভাবা উচিত। বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, বৃহত্তম স্থলবন্দর পেট্রাপোলে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে ভারতের কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বিক্ষোভ সমাবেশে নেতৃত্ব দেন। সমাবেশে হাবড়া, বারাসাত, নদীয়া, কল্যাণীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ৭-৮ হাজার বিজেপি কর্মী যোগ দেন। মিছিলকারী বিশ্ব হিন্দু জোট গড়ে তুলতে বাংলাদেশবিরোধী নানা উসকানিমূলক স্লোগান দেন।
ঢাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ : বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক জানান, ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশে উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গতকাল প্রথমে সন্ধ্যায় ছাত্র অধিকার পরিষদ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ইনকিলাব মঞ্চ ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সমাবেশে বক্তারা বলেন, একটা সভ্য দেশ কখনো অন্য দেশের দূতাবাসে হামলা করতে পারে না। ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
বিক্ষোভে উত্তাল রাবি, ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক : রাবি প্রতিনিধি জানান, বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। এতে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়া হয়। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিক্ষোভ নিয়ে শিক্ষার্থীরা নগরীর তালাইমারীতে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে অবস্থান কর্মসূচি করেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, আগরতলায় বাংলাদেশি সহকারী হাইকমিশনে হামলা ন্যক্কারজনক ঘটনা। এই হামলা জেনেভা কনভেনশন বিরোধী। বাংলাদেশের মানুষ সাম্রাজ্যবাদী নয় বরং ভারতেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মুসলিম ও হিন্দু নির্যাতিত হয়। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করে। অথচ ভারত বিশ্বব্যাপী মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে সাম্প্রতিক দাঙ্গা উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এ ছাড়া জবি প্রতিনিধি জানান, একই ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল রাতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
মিছিলটি ক্যাম্পাসের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে থেকে শুরু হয়ে প্রধান ফটক বাহাদুর শাহ পার্ক, শাঁখারীবাজার, রায়সাহেব বাজার মোড় ঘুড়ে পুনরায় ক্যাম্পাসের গুচ্ছ ভাস্কর্য চত্বরে এসে শেষ হয়।
শেকৃবি প্রতিনিধি জানান, বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল রাতে মিছিলটি ক্যাম্পাসের সেকেন্ড গেট থেকে শুরু হয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, আগারগাঁও, সেকেন্ড গেট হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাংলোতে থামে। এ ছাড়া ইসকনের প্রতীক এবং ইসরায়েলের পতাকা প্রশাসন কর্তৃক মুছে ফেলার কারণ জানতে ভিসি বাংলোর সামনে অবস্থান করেন শিক্ষার্থীরা। উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত অবস্থান করবেন বলে জানান তারা।
সমাবেশস্থল থেকে মাইকের শব্দ বাংলাদেশের ৫০০ গজ অভ্যন্তরে পর্যন্ত শোনা যায়। যোগদানকারীরা গেরুয়া পতাকা নিয়ে নোম্যান্সল্যান্ডের কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ ও ইউনূস সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডের সমালোচনা করে স্লোগান দিতে থাকে এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ দাবি করে ইউনূস সরকারের পদত্যাগ চায়। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে মিছিলকারীরা নোম্যান্সল্যান্ডে প্রবেশের চেষ্টা করলে বিএসএফের বাধার মুখে মিছিলকারীরা পিছু হটে পেট্রাপোল বন্দরের দিকে ফিরে যায়।
বিক্ষোভ সমাবেশে শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ভারতে পলাতক আওয়ামী লীগের নেতাদের পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। হিন্দুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসসহ অন্য সন্ন্যাসীদের বিনা শর্তে মুক্তি দিতে হবে। হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সোমবার (গতকাল) স্থানীয় সময় সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার (আজ) সকাল ৬টা পর্যন্ত কোনো পণ্যবাহী ট্রাককে বাংলাদেশে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। এটা কেবলমাত্র ট্রেলার দেখলাম। এর পরও অত্যাচার বন্ধ না হলে আমরা টানা পাঁচ দিন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ বাণিজ্য বন্ধ করব। আগামী বছরে লাগাতার বাণিজ্য বন্ধ করে দেব। এর পর ওরা কীভাবে আলু, পিঁয়াজ খায় সেটা আমরা দেখিয়ে দেব।