সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিম্নকক্ষে সংসদ সদস্যের দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে বিরোধী দলের সদস্য থেকে মনোনয়ন, নিম্নকক্ষের নারী আসন এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। যদিও এ চার ইস্যুতে ঐকমত্যের জন্য বৈঠকের আয়োজন করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গতকাল প্রথম দিন এসব বিষয়ের ওপর ঐকমত্য না হওয়ায় আরও আলোচনা হবে বলে কমিশন ও দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হয়। এতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের আস্থা ভোটের পক্ষে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ঐকমত্য পোষণ করেছে। বিএনপি ও এনসিপি বলেছে, সরকারের স্থায়িত্বের জন্য এ বিধান প্রয়োজন। তবে কোনো কোনো দল বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনার জন্য বলেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করে এবং উপমহাদেশের চর্চা বিবেচনা করে তাঁর দলের পক্ষ থেকে উপযুক্ত মত হচ্ছে, ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আস্থা ভোট না থাকলে সরকার পরিচালনায় স্থায়িত্ব থাকবে না। প্রতিনিয়ত সরকার পরিবর্তিত হতে থাকবে, যা শোভনীয় হবে না। আস্থা ভোট, অর্থবিল এবং সংবিধান সংশোধন ছাড়া সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত প্রদান করবেন, এতে বিএনপি একমত। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে এ আস্থা ভোটের বিষয়টি ৭০ অনুচ্ছেদে যুক্ত করতে বিএনপি প্রস্তাব করেছে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক, সংস্কার সমন্বয় কমিটির সমন্বয়ক সারোয়ার তুষার বলেন, অর্থ বিলের পাশাপাশি আস্থা ভোট থাকতে হবে, কারণ সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা যেমন দরকার, তেমন সরকারের স্থিতিশীলতা দরকার। আস্থা ভোট রেখে দিলে প্রধানমন্ত্রী আনচ্যালেঞ্জড্ থেকে যাবেন উল্লেখ করে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছেন, এ প্রসঙ্গে কোনো উপায় বের করতে হবে। এক দিনে শেষ না করে আরেকটি আলোচনায় বসে কোথায় ঐকমত্য হলো তা চূড়ান্ত করতে হবে। আর সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থবিল, আস্থা ভোট ও সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত বিষয় ছাড়া সব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। আমাদের প্রস্তাব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন হতে হবে।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক আমরা তা কোনোভাবেই চাই না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থায়িত্ব তিন মাসের বেশি হওয়া উচিত না এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন তাদের এখতিয়ারে থাকা উচিত না।’
‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে আমরা একমত আছি’ বলে মন্তব্য করেছেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার। তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হোক এটা সবাই চায়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনও যদি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হয় সেটা ভালো হবে। কিন্তু টেকনিক্যাল দিকগুলো নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। আপাতত আমরা নীতিগতভাবে এটার সঙ্গে একমত আছি।’ তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো দল প্রস্তাব দিচ্ছে, আমরা এটা ভেবে দেখছি যে স্থানীয় মানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ চার মাসের জায়গায় ছয় মাস হতে পারে কি না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে এখনো আলোচনা হয়নি। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে আমরা একমত আছি।’
এদিকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো নিয়ে কমিশনের প্রস্তাব সম্পর্কেও মত দেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, তাঁদের প্রস্তাব ছিল সব স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান বিরোধী দলের হবে। এটা বাস্তবতাবহির্ভূত। কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান বিরোধী দলের পক্ষ থেকে হতে পারে, কিন্তু সবাই যদি বিরোধী দল থেকে হয়, তবে সরকার তার কার্য পরিচালনা করতে সব সময় বাধাগ্রস্ত হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতেই হবে জাতীয় সনদ : অধ্যাপক আলী রীয়াজ
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, সংস্কার কার্যক্রমে বিভিন্ন কমিশনের প্রস্তাবই চূড়ান্ত নয়। রাজনৈতিক দলগুলো যেসব মতামত দিয়েছে তার ভিত্তিতে পরিবর্তিত প্রস্তাব নিয়েই রচিত হবে জাতীয় সনদ। তিনি বলেন, সব প্রস্তাবে ঐকমত্য হবে না। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না, সেগুলো জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত হবে না উল্লেখ করে কমিশনের সহসভাপতি বলেন, ‘আমরা কিছু জায়গায় একমত হব, বাকিটা রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করবে। জনগণ কতটা গ্রহণ করবে সেটা তাদের বিষয়।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের সময়ের স্বল্পতা রয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কী কাজ করছে তা জানতে জনগণের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে জনগণ আমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হতে পারে।’ জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় সনদ তৈরির কাজ সম্পন্ন হবে এ আশাবাদ ব্যক্ত করে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে আমরা যেন ন্যূনতম ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারি।’