জুলাইয়ের মধ্যেই আলোচিত ‘জুলাই সনদ’ তৈরির চ্যালেঞ্জ নিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এজন্য সর্বোচ্চ ৩১ জুলাই পর্যন্ত সময় নেওয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছে কমিশন। তার আগেই জুলাই সনদ তৈরিতে ব্যর্থতার প্রসঙ্গ উঠেছে। প্রথমে দলগুলো একে অন্যের দিকে সমালোচনার তির ছুড়লেও পরে এতে যোগ দেয় কমিশন নিজেই। তারা খোলামেলাভাবে ব্যর্থতার বিষয়টি তুলে ধরে। সব মিলিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের মৌলিক ইস্যুতে সংলাপ টেবিলে দেখা যাচ্ছে বিভেদ। টেবিলের বাইরে দোষারোপ করা হচ্ছে পরস্পরকে। মৌলিক কয়েকটি ইস্যুতে নিজেদের অনড় অবস্থানের বিষয় স্পষ্ট করেছে দলগুলো। রাজনীতিবিদরা বলছেন, জুলাই সনদ তৈরি সম্ভব না হলে এর দায় আসলে কেউই নিতে চাইবে না।
এমন অবস্থায় হঠাৎ ব্যর্থতার দায়ের প্রসঙ্গ টেনেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। ১৫ জুলাই তিনি ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের শুরুতে বলেন, ‘যদি আমরা কোথাও ব্যর্থ হই, সে ব্যর্থতা আমাদের সবার। কমিশনের ব্যর্থতা যদি হয়, তাহলে এটা সবার ব্যর্থতা হবে। তাই ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে দায়িত্ব আমাদের ওপর অর্পিত হয়েছে, সে দায়িত্ব রাজনৈতিক দল হিসেবে আপনাদের। আমরা আপনাদের প্রচেষ্টার অংশীদার হয়েছি, আলাদা সত্তা হিসেবে যুক্ত হইনি।’ রাজনৈতিক দলগুলোকে এক বছর আগের পরিস্থিতি অনুধাবন করার অনুরোধ জানান তিনি। ব্যর্থতার দায় নিয়ে কমিশনের সহসভাপতির কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য আসার পরই পাল্টা বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘জুলাইয়ের ভিতরে জুলাই সনদ না হলে তার দায় ঐকমত্য কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের।’ জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে শুক্রবার রাজধানীর পল্লবীতে বিআরটিসি বাস ডিপোর সামনে ঢাকা মহানগরী উত্তর বিএনপির মৌনমিছিলপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে তিনি এ মন্তব্য করেন। জাতীয় সনদ প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যারা আজ সংস্কার কমিশনে গিয়ে আলোচনা করছেন, খানাপিনা খাচ্ছেন, সন্ধ্যাবেলায় চলে যাচ্ছেন এবং কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না; অথচ আমাদের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা চলছে অবিরাম। বিএনপির কারণে নাকি সংস্কার হচ্ছে না।’ সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যে দলটি সব সময় বিভ্রান্তিমূলক রাজনীতি বাংলাদেশে করেছে; একসময় স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গেছে, আরেক সময় জনগণের বিরুদ্ধে গেছে, আরেক সময় মানুষের সেন্টিমেন্টের বিরুদ্ধে গেছে। তারা সব সময় বিভ্রান্তিমূলক রাজনীতি করে। এবার ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। আমি নাম নেব না, আপনারা বুঝে নিন। বাংলাদেশের মানুষ সবই বোঝে।’ আরেকটি দলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যারা নাকি হাতপাখা দিয়ে ১৬ বছর আওয়ামী লীগকে বাতাস করেছে, তারা নাকি কোথাও পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন চায় না। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি দল, যে সব সময় বিভ্রান্তিমূলক রাজনীতি করেছে।’
অন্যদিকে কমিশনের সংলাপের ছায়া সমালোচনা করে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘মেজরিটিসংখ্যক দলই পিআর পদ্ধতিকে সাপোর্ট দিচ্ছে। শুধু এক লাইনে ব্যাখ্যা দিতে চাই-জনসমর্থনের দিক থেকে পাঁচ-ছয়টা দল হলো বিএনপি, এনসিপি, চরমোনাই পীর, সব ইসলামী দল, গণঅধিকার পরিষদ। আমরা পিআরের পক্ষে আছি। দু-একটি দল না চাইলে কোনো প্রস্তাব আটকে যাওয়াটা ইনজাস্টিস হবে, বৈষম্য হবে। কারণ মেজরিটি তো পক্ষেই আছে।’ এদিকে মৌলিক সংস্কার প্রশ্নে বিএনপি বিরোধিতা করছে দাবি করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘অধিকাংশ দল উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে একমত হলেও বিএনপিসহ গুটিকয় দল আপত্তি জানিয়েছে। এখন উচ্চকক্ষের আলোচনা বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। সংস্কারকে এখন সংখ্যাতাত্ত্বিক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যেমন ২০টি সংস্কার প্রস্তাব, আমরা ১২টা মেনেছি, ৮টা মানিনি, সবই কেন মানতে হবে, এমন কথা বলা হচ্ছে। যখন মৌলিক সংস্কারের কথা আসছে, তখন তারা বেঁকে বসছেন। কিন্তু মৌলিক সংস্কারের প্রশ্নে এনসিপি কোনো ছাড় দেবে না। মৌলিক সংস্কার ছাড়া জুলাই সনদের দিকে নিয়ে যাওয়া হলে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে না। সে ক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়টি যদি মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়, আমরা সেটাই করব।’
অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিজেরাই ঐক্য বিলম্ব কমিশনে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (এনডিএম) মহাসচিব মোমিনুল আমিন। তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার সুস্পষ্ট বক্তব্য এবং তাঁদের টার্মস অব রেফারেন্স অনুযায়ী যেসব বিষয়ে সব দল ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে সেগুলোই জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা। কিন্তু তাঁরা প্রতিনিয়ত ঐকমত্যে না আসা বিষয়ে নতুন প্রস্তাব নিয়ে এসে কালক্ষেপণ করছেন। তাহলে গত ছয় মাসে ঐকমত্য কমিশনের পেছনে রাষ্ট্রের কত অর্থ খরচ হয়েছে জাতি জানতে চায়।’ ব্যর্থতার দায় একে অন্যের ওপর বর্তানোর পাশাপাশি সংবিধানে জুলাই সনদের স্বীকৃতি দেওয়া নিয়েও বিতর্কে জড়িয়েছে কয়েকটি দল। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দলের চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছে। গণ অভ্যুত্থানকে যথাযথ মর্যাদায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে চায় বিএনপি। ঘোষণাপত্রের রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলেও সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত থাকে না। জুলাই ঘোষণাপত্র সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে যুক্ত করা যেতে পারে।’ একই প্রসঙ্গে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘এনসিপি মনে করে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করতে হবে এবং জুলাই আন্দোলনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রয়োজন। আমরা রাষ্ট্র পরিচালনায় নতুন সংবিধানে মূলনীতি হিসেবেই জুলাই সনদের স্বীকৃতি চাই। আপাতত এটাই আমাদের দলীয় অবস্থান।’