জুলাই গণ অভ্যুত্থানে গত বছর আজকের এই দিনে আন্দোলনের মোড় ঘুরে যায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের এই প্রথম দিনটিতে লাশের পর লাশে রক্তাক্ত হয় পুরো দেশ। আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা ফ্যাসিস্ট হাসিনার মসনদ রক্ষায় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানে। রাজধানীসহ জেলা পর্যায়ে ত্রিমুখী সংঘর্ষ ও গুলিতে প্রাণ হারান পুলিশসহ ১০৪ জন। তাদের মধ্যে ১৪ জন পুলিশ, ১৯ জন আওয়ামী লীগার এবং বাকিরা আন্দোলনরত ছাত্র, পেশাজীবী ও রাজনৈতিক কর্মী। সবচেয়ে বেশি নিহত হয় সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় ১৩ পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আন্দোলনকারী, আওয়ামী লীগকর্মী ও পুলিশের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষে বিক্ষোভের আগুন পৌঁছে যায় শহর-নগর-গ্রামে। আওয়ামী লীগ এমপি-মন্ত্রীদের বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। ভয়াবহ এই পরিস্থিতিতে নতুনভাবে কারফিউ ঘোষণা করে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার। কারফিউ প্রত্যাখ্যান করে পরদিন ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
সেদিন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি গভীর সংকটময় মুহূর্তের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আমাদের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্ট পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সারা দেশের ছাত্র-জনতাকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘চূড়ান্ত জবাব দেওয়ার সময় এসে গেছে। ইতিহাসের অংশ হতে সবাই ঢাকায় আসুন। আশপাশের জেলাগুলো থেকে সবাই ঢাকায় আসবেন। আর যাদের যাদের সুযোগ রয়েছে তারা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়ে যান। ঢাকায় এসে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা রাজপথগুলোতে অবস্থান নিন। চারদিক থেকে আমরা গণভবনের দিকে রওনা হব। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ‘গুন্ডারা’ পুলিশের অস্ত্র নিয়ে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করেছে। কিন্তু ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে তারা টিকে থাকতে পারেনি। রাজপথের পরাজিত শক্তি হিসেবে তারা বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আমাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে হবে। আনন্দের বিষয় হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। আবার মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলতে চাই, আপনারা এই দেশের নাগরিক। জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। আপনারা দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করবেন। কোনো খুনি রাজনৈতিক দলের জন্য কাজ করবেন না। এটিই দেশের মানুষ আপনাদের কাছে প্রত্যাশা করে।’ অন্য সমন্বয়করাও একযোগে এ কর্মসূচির লিখিত ও ভিডিও বার্তা প্রচার করেন। এদিকে, পূর্বঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ৪ আগস্ট সকাল থেকেই রাজপথে নামতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে অংশ নেন শিক্ষক-অভিভাবকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। এদিন দুপুরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ, বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে মৃত্যুর খবরের পর অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ ঘোষণা করে সরকার। এ কারফিউ প্রত্যাখ্যান করে এই ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের এক দফা দাবি উত্থাপন আর দাবি আদায়ের আগ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। এতে করে কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে এদিন একাত্মতা প্রকাশ করেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। ছাত্র আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে রাজপথে নামেন শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ। এর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে অভিভাবক, গৃহিণীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের মধ্যে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেয় নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীরাও। প্রতিবাদী উত্তপ্ত স্লোগানে গলা মেলায় সর্বস্তরের জনতা। সব মিলিয়ে গত বছর ৪ আগস্ট দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ এবং বজ্রকঠিন প্রতিরোধের মুখে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।