আওয়ামী লীগ শাসন আমলে কেবল ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে অবৈধভাবে একটি সরকার দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় দেশে জবরদখলের শাসন চালায়নি, বরং একটি মাফিয়াতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। আওয়ামী লীগের যে তথাকথিত সাংবিধানিক সরকার, সেই সাংবিধানিক সরকারের প্রধান ছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু এই সরকার ছিল একটি উপরি কাঠামো মাত্র। আসলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে ছিল মাফিয়াতন্ত্রের জোরে। আর সেই মাফিয়াতন্ত্রের কাজ ছিল দুর্নীতি, লুটপাট, গুম, হত্যাকাণ্ড, বিরোধী মতকে দমন এবং অর্থ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার। আওয়ামী লীগের ওপরের ভাগের সরকারের প্রধান যদি হন শেখ হাসিনা, তবে মাফিয়াতন্ত্রের প্রধান ছিলেন তারিক সিদ্দিক। এই মাফিয়াতন্ত্রের কথায় চলত দেশ। তারিক সিদ্দিক শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয়। শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার স্বামীর আপন ভাই। আর সেই সূত্রে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিপুলভাবে ক্ষমতাবান। বাংলাদেশে অপরাধ এবং দুর্নীতি জগতের নিয়ন্ত্রণ ছিল তারিক সিদ্দিকের হাতে। এমন কোনো দুর্নীতি নেই, যেখানে তারিক সিদ্দিকের হস্তক্ষেপ ছিল না। কাগজে কলমে তিনি ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা। তিনি গণমাধ্যমে আসতেন না। পর্দার আড়ালে থাকতেন। যেভাবে মাফিয়া ডনরা নেপথ্যে থেকে সব কলকাঠি নাড়ায় সেভাবেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন তারিক সিদ্দিক।
তারিক সিদ্দিকের দুর্নীতি বহুমাত্রিক এবং সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান। তবে তার সবচেয়ে বড় দুর্নীতি সেনা কেনাকাটায়। ধারণা করা হয়, গত ১৫ বছরে সেনাবাহিনীর কেনাকাটায় প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা লুট করেছেন তারিক সিদ্দিক। তারিক সিদ্দিকের নির্দেশে সেনাবাহিনীর সব কেনাকাটা হতো। যারা এ কাজ পেত তাদের প্রধান প্রথম দায়িত্ব ছিল তারিক সিদ্দিককে কমিশনের টাকা দেওয়া। ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন গ্রহণ করতেন এই মাফিয়া অধিপতি। তার সম্মতি ছাড়া সেনাবাহিনীতে কোনো কিছুই কেনাকাটা হয়নি।
সাম্প্রতিক সময় উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। বহু শিশু সেখানে প্রাণ হারিয়েছে। গোটা বাংলাদেশ শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। বিমানবাহিনীতে বহু বছরের পুরোনো বিমান ব্যবহার নিয়ে উঠেছে জনমনে নানা প্রশ্ন। কেন, কীভাবে এ প্রশিক্ষণ বিমান কেনা হয়েছে সে ব্যাপারে অনুসন্ধান করে পাওয়া গেছে, চাঞ্চল্যকর তথ্য। এসব বিমান উড্ডয়নের অযোগ্য, পরিত্যক্ত। তারিক সিদ্দিকের আগ্রহে এবং নির্দেশে এসব বিমান কেনা হয়েছিল। একাধিকবার এ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। পাইলটরা প্রাণ হারিয়েছেন। তবে এবার সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এ বিমানের কেনাকাটার বিষয়টি সামনে এসেছে।
চীন থেকে এ বিমান কেনা হয়েছিল বাজার মূল্যের প্রায় তিন গুণ বেশি দামে। তারিক সিদ্দিক এসব যুদ্ধবিমান কিনে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা কমিশন গ্রহণ করেছেন। এসব বিমান এতই নিম্নমানের যে সবসময় দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, এ বিমানগুলো কেনার পরই বিমানবাহিনী থেকে আপত্তি জানানো হয়। বলা হয়েছিল যে, এ ধরনের প্রশিক্ষণ বিমান ব্যবহার বিমানবাহিনীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং এখানে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু তারিক সিদ্দিক বলে কথা। যারা প্রতিবেদন দিয়েছিল, তাদেরই অপসারণ করা হয়।
প্রশিক্ষণ বিমান শেষ পর্যন্ত কেনা হয়। শুধু বিমান কেনা নয়, সেনা সশস্ত্র বাহিনীর সব কেনাকাটায় এ দুর্বৃত্তের দুর্নীতির চিহ্ন রয়েছে। ১৯৯৬ সালেও তারিক সিদ্দিক বিমান কেনাকাটায় একই রকম দুর্নীতি করেছিলেন। মিগ-২৯ এবং ফ্রিগেট বিএনএস বঙ্গবন্ধু ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়ে তার বিরুদ্ধে উঠেছিল হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ। এ দুর্নীতির অভিযোগে ২০০১ সালে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ মামলা কোনো রকম শুনানি ছাড়াই নিষ্পত্তি করে দেওয়া হয়। তাদের খাস করে দেয় আদালত। সেনাবাহিনীতে অস্ত্র কেনা, পোশাক ক্রয়সহ বিভিন্ন কেনাকাটায় তারিক সিদ্দিক কমিশনের কথা সশস্ত্র বাহিনীদের ছিল ওপেন সিক্রেট। সশস্ত্র বাহিনীর কেনাকাটা সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম তদারকি করতেন তারিক সিদ্দিক। তাকেই এ কেনাকাটার দায়িত্ব দেওয়া হতো, যিনি তারিক সিদ্দিকের একান্ত আবদার মেটাতেন বিনা প্রশ্নে। এ সময় সশস্ত্র বাহিনী আন্তর্জাতিক মানের অস্ত্র, গোলাবারুদ কেনার বদলে চীনমুখী অস্ত্র গোলাবারুদ কেনা শুরু করে। অতীতে সশস্ত্র বাহিনী ইউরোপ থেকে, বিশেষত হাঙ্গেরি, জার্মান থেকে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ক্রয় করত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনা হতো, যেগুলো গুণেমানে ছিল উন্নত এবং আধুনিক। কিন্তু এসব দেশ তারিক সিদ্দিকের চাহিদা অনুযায়ী কমিশন দিতে পারত না। ফলে তারিক সিদ্দিক দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করেন। ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ অস্ত্র, গোলাবারুদ কেনায় চীনমুখী হয়ে পড়ে। চীনের সঙ্গে কেনাকাটার সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল চীন সহজেই কমিশন দিতে রাজি হতো। আর সে কারণেই চীন থেকে অস্ত্র ও সাঁজোয়া সরঞ্জাম ক্রয়ের ব্যাপারে তারিক সিদ্দিকের ব্যাপক আগ্রহ ছিল।
সেনাবাহিনী ক্রয়ের কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। এ ক্রয় সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার অংশ। যেহেতু এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, সেজন্য এ টেন্ডার প্রক্রিয়াগুলো করা হয় গোপনীয়তার সঙ্গে। কাজেই কে কাজ পেল, না পেল বা কে সর্বনিম্ন দরদাতা ইত্যাদি কোনো কিছুই প্রকাশ্যে যাচাই-বাছাই করার সুযোগ থাকে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সব দেশই সশস্ত্র বাহিনীর নিরাপত্তা, গোপনীয়তা এবং দেশের সার্বভৌমত্বের স্বার্থে এ ধরনের ব্যবস্থা বিদ্যমান। আর এ ব্যবস্থাটিরই সুযোগ নিয়েছিলেন তারিক সিদ্দিক, যিনি সেনা ক্রয় সংক্রান্ত ক্রয়কে তার আয়ের উৎস বানিয়ে ফেলেছিলেন। আর এসব কেনাকাটার জন্য তিনি প্রথম দিকে কমিশন গ্রহণ করলেও আস্তে আস্তে নিজের নিকটতম লোকজনকে দিয়ে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র আমদানি এবং বিক্রির লাইসেন্স বানিয়ে ফেলেন। এসব প্রতিষ্ঠানই শেষ পর্যন্ত কেনাকাটার কাজগুলো পেত।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, এ সময় আর্মস ফোর্সেস গোল বাস্তবায়নের জন্য সেনাবাহিনীতে বিপুল পরিমাণ কেনাকাটা হয়েছিল। সেনাবাহিনীকে উন্নতকরণ, আধুনিকীকরণের জন্য এ কেনাকাটাগুলো করা হয়। প্রাক্কলিত কেনাকাটার পরিমাণ গত ১৫ বছরে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। এখান থেকে যদি তারিক সিদ্দিক ১৫ শতাংশ হারেও কমিশন নিয়ে থাকেন, সেই কমিশন বাবদ তারিক সিদ্দিক পেয়েছেন ১৫ হাজার কোটি টাকা।
অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং সেনা সরঞ্জাম কেনাকাটা ছাড়াও এ সময় সেনাবাহিনীতে প্রচুর পরিমাণ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ হয়েছে। গত ১৫ বছরে বিভিন্ন স্থানে নতুন ক্যান্টনমেন্ট নির্মাণ, আধুনিকীকরণের মতো বড় বড় প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাক্কলিত হিসেবে দেখা গেছে যে, আওয়ামী লীগ শাসনামলে ১৫ বছরে সেনাবাহিনীর সেনানিবাস স্থাপন, উন্নয়ন, সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ এবং সশস্ত্র বাহিনীতে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ বাবদ প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এসব কাজ যারা পেয়েছে, তাদের প্রত্যেককে তারিক সিদ্দিককে নির্দিষ্ট অঙ্কের কমিশন দিতেই কার্যাদেশ নিতে হয়েছে।
ফলে সেনাবাহিনীর বিপুল পরিমাণ উন্নয়নের আড়ালে রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। বিশেষ করে বড় বড় যে সেনানিবাস নির্মিত হয়েছে, সেখানে দুর্নীতি হয়েছে ব্যাপকভাবে এবং কোনো রকম জবাবদিহি ছাড়াই। তারিক সিদ্দিকের দুর্নীতির ব্যাপ্তি ছিল এমনভাবে বিস্তৃত যে সশস্ত্র বাহিনীর স্থাপনা নির্মাণ, ক্যান্টনমেন্ট নির্মাণ বা অন্য যে কোনো বাহিনীর স্থাপনা নির্মাণের ব্যাপারে এমন ব্যক্তিদেরই টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হতো, যারা তারিক সিদ্দিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ।
তারিক সিদ্দিকের সবুজ সংকেত নিয়েই তারা টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করত। আগে থেকেই জানা যেত যে, এই কাজটি কে পাবে। তারিক সিদ্দিকের ইশারা ছাড়া কেউ কোনো কাজ পেত না। এটাই ছিল সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ম। এভাবেই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য বরাদ্দ টাকা লুট করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তারিক সিদ্দিক।
এ সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, রাস্তাঘাট ও ব্রিজ উন্নয়নের কাজও সেনাবাহিনীকে দিয়ে করানোর নতুন ব্যবসা শুরু করেন। সশস্ত্র বাহিনী ভালো কাজ করে, দুর্নীতি হয় না- এ যুক্তি দিয়ে ‘ডাইরেক্ট পারচেজ’ বা সরাসরি ক্রয় ব্যবস্থা ব্যাপক জনপ্রিয় হয় আওয়ামী লীগের শাসনামলে। এটির নেপথ্যে ছিলেন তারিক সিদ্দিক। এখানে টেন্ডার ছাড়াই সশস্ত্র বাহিনীর নামে কাজ নেওয়া হতো। এই তৃতীয় পক্ষ ছিল বেসরকারি ঠিকাদার। বেসরকারি ঠিকাদার নির্ধারণ করতেন তারিক সিদ্দিক। মোটা অঙ্কের কমিশন নিয়ে তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে কাজ করানো হতো। এভাবে তারিক সিদ্দিক লুট করতেন কোটি কোটি টাকা। প্রাক্কলিত হিসাব থেকে দেখা যায় যে, তারিক সিদ্দিক ১৫ বছরে সশস্ত্র বাহিনী থেকে কমিশন বাবদ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি গ্রহণ করেছেন। যে টাকার প্রায় সবই তিনি বিদেশে পাচার করেছেন।