ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এনে ১২৭ বছরের পুরোনো ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফৌজদারি কার্যবিধিতে (সিআরপিসি) যুক্ত করা হয়েছে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা রোধে আবশ্যিকভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান। এ ছাড়া সংশোধিত বিধানগুলোতে গ্রেপ্তার, তদন্ত, জামিন, বিচারসহ পুরো প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। বিচারপ্রার্থী ও আসামিদের সুরক্ষায় যুক্ত হয়েছে নতুন ধারা। ১৮৯৮ সালের আইনের এ সংশোধনীতে ডিজিটাল মাধ্যমে অর্থাৎ মোবাইল ফোনে কল করে অথবা এসএমএসের মাধ্যমেও সমন জারির বিধান যুক্ত করা হয়েছে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ ‘ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ অধিকতর সংশোধনকল্পে প্রণীত অধ্যাদেশ’ এর গেজেট গত রবিবার প্রকাশ করে। সেখানে সংশোধনীর বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির সংশোধনীতে বলা হয়েছে, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে আদালতে আনা হলে ম্যাজিস্ট্রেট মোট ১৫ দিনের বেশি নয়, এমন মেয়াদের জন্য হেফাজতের অনুমতি দিতে পারেন। তার বেশি হলে কেবল বিচারিক হেফাজত দেওয়া যাবে। হেফাজতের মেয়াদ শেষ হলে দ্রুত অভিযুক্তকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে। হাজিরের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্যাতনের অভিযোগ করলে ম্যাজিস্ট্রেট নিকটবর্তী সরকারি হাসপাতালে মেডিকেল পরীক্ষা করাবেন। নির্যাতনের প্রমাণ পেলে ম্যাজিস্ট্রেট আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। গ্রেপ্তার থাকা অবস্থায় অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর শর্ত হলো- ওই ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে, মামলার ডায়েরির কপি দিতে হবে, ব্যক্তিকে নিজের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে এবং আবেদনটি যথাযথ হতে হবে। যদি ম্যাজিস্ট্রেটের বিশ্বাস হয় যে কোনো কর্মকর্তা বেআইনিভাবে কাউকে আটকের জন্য আবেদন করেছেন, তাহলে তিনি ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। তদন্ত চলাকালে পুলিশ কমিশনার, জেলা পুলিশ সুপার বা সমমানের কর্মকর্তা তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে একটি অন্তর্বর্তী তদন্ত প্রতিবেদন দিতে তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিতে পারবেন। অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে যদি দেখা যায়, কোনো আসামির বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই, তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সেটি ম্যাজিস্ট্রেট বা ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিতে পারবেন। আদালত যথাযথভাবে সন্তুষ্ট হলে ওই আসামিকে অব্যাহতি দিতে পারবেন; তবে বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলবে। পরবর্তী সময়ে তদন্ত শেষে যদি নতুন ও পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে পূর্বে অব্যাহতি পাওয়া আসামিকেও চূড়ান্ত পুলিশ রিপোর্টে অভিযুক্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। তদন্ত শেষের সময়সীমা উল্লেখ করে সংশোধনীতে বলা হয়েছে, অপরাধের তথ্য পাওয়ার দিন থেকে ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। যৌক্তিক কারণে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করা না গেলে তদন্ত কর্মকর্তা ডায়েরিতে কারণ লিখবেন। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সময় বাড়ানোর আবেদন করবেন। ম্যাজিস্ট্রেট যুক্তিসংগত সময় বাড়াতে পারেন। তারপরও শেষ না হলে তদন্ত কর্মকর্তা লিখিতভাবে বিলম্বের কারণ ম্যাজিস্ট্রেট ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানাবেন। ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে অন্য কর্মকর্তার মাধ্যমে তদন্ত করাতে পারবেন। বিলম্ব ও তদন্তে গাফিলতির জন্য ম্যাজিস্ট্রেট শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিতে পারবেন। এখন থেকে নালিশি দরখাস্তের মাধ্যমে দায়েরকৃত সব সিআর মামলাই বাদীর অনুপস্থিতির কারণে খারিজ হবে। আগে শুধু সমন দেওয়া হয়েছে এমন সিআর মামলা খারিজ করা যেত। সংশোধিত বিধান অনুযায়ী, এখন থেকে আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার করার জন্য ক্রোকি ও হুলিয়া পরোয়ানা জারির কোনো আবশ্যকতা থাকবে না। পলাতক আসামির মামলা দ্রুততর সময়ের মধ্যে বিচারের জন্য প্রস্তুত হবে। পলাতক আসামিকে আদালতে উপস্থিত হওয়ার আদেশ দুটি পত্রিকার পরিবর্তে বহুল প্রচলিত একটি বাংলা পত্রিকায় এবং পাশাপাশি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার বিধান সন্নিবেশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত হাজিরা শিথিল ও সাক্ষ্য গ্রহণে নতুন সুযোগ দেওয়া হয়েছে সংশোধিত ফৌজদারি কার্যবিধিতে। আগে মামলা শুরু হওয়ার পর থেকেই আসামিকে বারবার ব্যক্তিগত হাজিরা দিতে হতো। জামিনপ্রাপ্ত আসামিরও এই ভোগান্তি থেকে মুক্তি ছিল না। এখন আদালত চাইলে তদন্ত প্রতিবেদনের শুনানি পর্যন্ত জামিনপ্রাপ্ত আসামিকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিতে পারবেন। এ সময় আসামি তার আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দিতে পারবেন।