১৭ আগস্ট, ২০২২ ১৫:৫০
ভারতীয় দুই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাক্ষাৎকার

‘রোগ কখনো চেপে রাখতে নেই’

শামীম আহমেদ


‘রোগ কখনো চেপে রাখতে নেই’

ডা. সঞ্চয় পান্ডে ও ডা. বিশাল পেশাত্তিওয়ার (ডানে)

প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করালে অনেক জটিল রোগ সহজেই ভালো হয়ে যায়। দেরি করলে জটিলতা বাড়ে। তাই রোগ কখনো চেপে রাখতে নেই। অনেক সময় কিছু রোগের কথা লজ্জায় আমরা চেপে রাখি। প্রাথমিক অবস্থায় রোগকে গুরুত্ব দেন না অনেকে। কখনো ভাবেন চিকিৎসায় হয়তো রোগটি ভালো হবে না। অথচ ছোট্ট একটি অস্ত্রোপচারে বড় একটা সমস্যার সমাধান হতে পারে। এমনকি একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও সুচিকিৎসায় স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে পারেন। প্রয়োজন শুধু সমস্যাটির জন্য সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসকের কাছে যাওয়া।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতের কোকিলাবেন ধীরুভাই আম্বানি হাসপাতালের স্পাইন সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. বিশাল পেশাত্তিওয়ার ও অ্যান্ড্রোলজি অ্যান্ড রিকনস্ট্রাক্টিভ ইউরোলজি বিভাগের প্রধান ডা. সঞ্চয় পান্ডে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলেন। মেরুদণ্ডের সমস্যা, ক্যান্সার, প্রজননতন্ত্র ও মূত্র সংবহনতন্ত্রের নানা জটিলতা ও আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে কথা বলেছেন এই দুই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

ডা. সঞ্চয় পান্ডে বলেন, লজ্জা ও না জানার কারণে অনেক মানুষ যৌন ও প্রজননতন্ত্রের নানা সমস্যা নিজের ভিতরে চেপে রাখে। ফলে সমস্যাটি বাড়তে থাকে। ছোট একটি অস্ত্রোপচারে অনেক জটিল যৌন সমস্যা ভালো হতে পারে সেটাই অনেকের অজানা।

তিনি বলেন, ৪০ থেকে ৭০ বছর বয়সের নারী, যারা একাধিক সন্তান জন্ম দিয়েছেন তাদের প্রস্রাব লিক করে। ৬০-৭০ ভাগ নারীর এ সমস্যা হয়। কেউ জানতে চাই না। নামাজের সময়, হাঁচি-কাশি দিলে, হাঁটাচলার সময় পেটে চাপ পড়ে প্রস্রাব বেরিয়ে যায়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ, ছোট্ট একটা অপারেশনে এটা ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু, লজ্জায় নারীরা কাউকে বলে না। ডায়াপার পরে, পানি পান কমিয়ে দেয়। এতে আরও ক্ষতি হয়ে যায়। ৪০ পার হওয়ার পর ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার, শারীরিক ও মানসিক চাপে অনেক মানুষের যৌন ক্ষমতা কমে যায়। পুরুষের ক্ষেত্রে এটা খুবই কমন। হরমোন কমে যাওয়ায় অনেকে পুরোপুরি যৌন অক্ষম হয়ে পড়ে। এর প্রভাব পড়ে দাম্পত্য জীবনে। এই সমস্যা পুরুষ লজ্জায় কাউকে বলে না। এমন ক্ষেত্রে পেনাইল ইমপ্লান্ট করলে ওই ব্যক্তি স্বাভাবিক যৌনজীবন ফিরে পেতে পারে। এছাড়া প্রতি চার হাজার নারীর মধ্যে একজন জরায়ু ও পূর্ণাঙ্গ যৌনাঙ্গ ছাড়া জন্মায়। ওই নারী কাউকে বিয়েও করতে পারে না। সন্তানও জন্ম দিতে পারে না। বাচ্চা অবস্থায় এই সমস্যা বোঝা যায় না। বয়ঃসন্ধিকালে যখন দেখবে মাসিক হচ্ছে না, তখন পরীক্ষা করলে ধরা পড়ে। এটাকে বলে এমআরকেএস সিনড্রোম। এসব ক্ষেত্রে কৃত্রিম যৌনাঙ্গ স্থাপন করে দিলে সে স্বাভাবিক যৌনজীবন ফিরে পেতে পারে। সারোগেসির মাধ্যমে মা হতে পারে।

তিনি বলেন, ৪০ বছরের পর হরমোন পরিবর্তনের কারণে প্রস্টেট বড় হয়ে প্রস্রাবের রাস্তায় চাপ দেয়। তখন ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব বের হয়। এটা নারী-পুরুষ সবার ক্ষেত্রে। এটা দীর্ঘদিন চললে ক্যান্সারের দিকে যেতে পারে। ওষুধেই এটা ঠিক হয়। না হলে লেজার অপারেশন করি। এজন্য প্রস্রাবে কোনো সমস্যা হলে, প্রস্রাবে রক্ত গেলে, ব্যথা হলে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। প্রস্রাবে রক্ত গেলে স্টোন থাকতে পারে, ক্যান্সার থাকতে পারে, ইনফেকশন হতে পারে। এমনকি যাদের কিডনি বা মূত্রথলিতে পাথর একবার হয়েছে, অপারেশনের পর তার আবার হতে পারে। এজন্য নিয়মিত চেকআপ করাতে হবে।

ডা. পান্ডে বলেন, জেন্ডার রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির মাধ্যমে এখন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে। আমরাই চিকিৎসা করছি। ট্রান্সজেন্ডার সমস্যা সারা বিশ্বে একটা বড় সংকট। এমন সমস্যা থাকলে কেউ বলতে পারে না। অনেকের হয়তো মানসিকতা পুরুষের, কিন্তু শরীর নারীর। আমরা সার্জারির মাধ্যমে অর্গান পরিবর্তন করে মানসিক এবং শরীরের কাজের সমন্বয়ের ব্যবস্থা করি। এই চিকিৎসা হরমোন থেরাপি, সাইক্রিয়াটিক কাউন্সেলিং, অর্গান স্টাবলিশ ও ভয়েস থেরাপির মাধ্যমে করা হয়। আমরা পুরো অর্গানই দিতে পারি। ভারতে এ বিষয়ে একটি আইন পাস হয়েছে। কে এই অপারেশন করতে পারে সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলা যাবে। এর জন্য প্লাস্টিক সার্জারি, সাইক্রিয়াটিসসহ একটি টিম কাজ করতে হয়। কোকিলাবেন হাসপাতালে সেই টিম রয়েছে।

তিনি বলেন, মডার্ন লাইফস্টাইলে চাপ অনেক বেশি। অনেক কাজ করি, ছুটিছাঁটা নেই, পানি কম খাই, চা-কফি-মদ্যপান করি। এসব কারণে সমস্যা বাড়ছে। সিগারেট ক্যান্সারের একটি অন্যতম কারণ। কিডনি ক্যান্সার, ইউরিনারি ব্লাড ক্যান্সারের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি থাকে ধূমপানে। এছাড়া প্রোস্টেট ক্যান্সার, রেক্টিকুলার ক্যান্সার, চোখে ক্যান্সার- এগুলোর রোবটিক সার্জারি করে চিকিৎসা দিচ্ছি আমরা। ডিউমার, কিডনি ক্যান্সার, ইউরেটিক ক্যান্সারসহ কিছু ক্যান্সারে আমরা কেটে অপারেশন করছি না। মিনিমালি ইনভেসিভ হোলস দিয়ে একেবারে নার্ভের কাছে গিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি মাধ্যমে করা হচ্ছে। ফলে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। এ ধরনের অপারেশন আগে পেট খুলে করা হতো।

প্রজনন ও মূত্র সংবহনতন্ত্র ঠিক রাখতে পেলভিক ফ্লোর এক্সারসাইজের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পানি পানের পরামর্শ দেন ডা. সঞ্জয় পান্ডে। তিনি বলেন, সমস্যা হলে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। না হলে জটিলতা বাড়বে। সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরীক্ষার জন্য প্রথম প্রস্রাব ছেড়ে মাঝের প্রস্রাবটা দিতে হয়, এটাও অনেকে জানে না। ফলে ভুল চিকিৎসা হয়। কারও বাবার প্রস্টেট ক্যান্সার থাকলে তার ছেলেরও হতে পারে। এগুলো জানা দরকার। রোগ সবার হতে পারে। এটা নিয়ে লজ্জা করলে হবে না।

মিনিম্যালি ইনভেসিভ এবং এন্ডোস্কোপিক স্পাইন সার্জন ডা. বিশাল পেশাত্তিওয়ার বলেন, অনেকের মেরুদণ্ডে জন্মগত ত্রুটি থাকে। নানা কারণে মেরুদণ্ডে ফ্রাকচার হতে পারে। এই অঞ্চলের ৪০-৭০ বছর বয়সসীমার অসংখ্য রোগী দেখেছি যারা ভুল পদ্ধতিতে ঘুমানোর কারণে মেরুদণ্ডের জয়েন্টে সমস্যা হয়। এসব সমস্যা নিয়ে বড় সার্জারি করা হলে রোগীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সময় লাগে। আমি গুরুত্ব দিই মিনিমালি ইনভেসিভ স্পাইন সার্জারিতে (এমআইএসএস)। এই পদ্ধতিতে অত্যাধুনিক টেকনোলজির মাধ্যমে খুবই ছোট আকারে সার্জারি করা হয়। সার্জারির দিনই রোগী হাঁটতে পারে। এক মাসে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে রোগী মোটরসাইকেলও চালাতে পারে।

তিনি বলেন, স্পাইন সার্জারির ক্ষেত্রে কোকিলাবেন হাসপাতালে রোবটের মাধ্যমে মেরুদণ্ডের স্ক্রুগুলো খুবই সূক্ষভাবে বসানো হয়। ফলে রোগীকে হাসপাতালে বেশি দিন থাকতে হয় না। তার মতে, কোমরে ব্যথা হলে অর্থপেডিক সার্জন, নিউরো সার্জন, নাকি স্পাইন সার্জনের কাছে যাবেন তা নিয়ে রোগীদের মধ্যে সংশয় থাকে। অর্থপেডিক ও নিউরো সার্জনরা হাড় ও ব্রেইনের পাশাপাশি স্পাইন সার্জারিও করতে পারেন। কিন্তু, স্পাইন সার্জনরা শুধুই স্পাইন সার্জারি করেন। অর্থাৎ, তিনি ওই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। যে বিষয়ে যিনি বেশি জানেন তার কাছে যাওয়াই ভালো। যে কোন সার্জারিতে জটিলতা থাকে। মাঝেমধ্যে সার্জারি ফেইল করতে পারে। তখন রি-সার্জারি করতে গেলে জটিলতা বাড়ে। আগে কারও সার্জারি ফেইল করলে কোকিলাবেন হাসপাতালে রি-সার্জারির ব্যবস্থা আছে।

এই দুই চিকিৎসক বলেন, সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। প্রস্রাবে রক্ত যাচ্ছে, ব্যথা আছে, কিডনিতে সমস্যা হচ্ছে, মেরুদণ্ডে সমস্যা হচ্ছে- এমন কিছু টের পেলে চুপ করে থাকবেন না। এই দেশে অনেক ভালো চিকিৎসক আছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

হাসপাতালটির ইন্টারন্যাশনাল পেশেন্ট ডিভিশনের প্রধান দীপক চাওলা বলেন, কোনো দেশের রোগী কোকিলাবেনের চিকিৎসককে দেখাতে চাইলে তার পরীক্ষার রিপোর্টগুলো হাসপাতালের ঠিকানায় ([email protected]) মেইল করতে হয়। তখন রোগীর সমস্যা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে মেইল আসবে। হাসপাতালে যাওয়ার আগেই তার জন্য চিকিৎসক নির্ধারিত থাকবেন। আবার ডায়াগনসিস রিপোর্ট দেখে ভারতে নেওয়ার দরকার মনে না হলে আমরা সেটাও বলে দিই।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর