শনিবার, ৪ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

কভিড-নাইনটিন অ্যান্ড প্রেগন্যান্সি

কভিড-নাইনটিন অ্যান্ড প্রেগন্যান্সি
যদিও সব বয়সের মানুষই আক্রান্ত হচ্ছে, তারপরও স্বস্তিদায়ক ব্যাপার হলো বাচ্চারা অনেকটা বিপদমুক্ত। গবেষকরা মনে করছেন এই ভাইরাস মানুষের দেহে আরাম করে বাসা বাঁধার জন্য যে পরিবেশ দরকার তা বাচ্চাদের দেহে তৈরি হয়নি।

এই মুহূর্তে সারা বিশ্ব কঠিন এক দুর্যোগের মুখোমুখি, যা মোকাবিলা করতে মানবজাতি হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। কভিড-নাইনটিন বা নভেল করোনা ভাইরাসের নানা দিক নিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে গবেষণা করছেন বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানী। তিন মাস হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত অনেক দিকই অজানা। কভিড-নাইনটিনে সারা বিশ্বের মৃত্যুহার পর্যালোচনা করলে যে কঠিন সত্যটি সামনে আসে তা হলো, বয়স্ক বা ষাটোর্ধ্ব মানুষের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ও মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। যদিও সব বয়সের মানুষই আক্রান্ত হচ্ছে, তারপরও স্বস্তিদায়ক ব্যাপার হলো বাচ্চারা অনেকটা বিপদমুক্ত। গবেষকরা মনে করছেন এই ভাইরাস মানুষের দেহে আরাম করে বাসা বাঁধার জন্য যে পরিবেশ দরকার তা বাচ্চাদের দেহে তৈরি হয়নি। প্রেগন্যান্ট বা গর্ভবতী মহিলাদের ওপর করোনাভাইরাস কি ধরনের প্রভাব ফেলে বা কি ধরনের চিকিৎসা করা হয়, এটা সত্যি খুব গুরুত্বপূর্ণ, সময় উপযোগী, জরুরি একটি বিষয়। আমি কিছু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিকেল জার্নাল যেমন, দি ল্যান্সেট ন্যাচার, আমেরিকান জার্নাল অব অবসটেট্রিক্স অ্যান্ড গাইনোকলজি, সিডিসি আরও কিছু জার্নাল পড়ে এ বিষয়ে কোনো গবেষণা হয়েছে কিনা জানার চেষ্টা করি। ল্যান্সেটে আমি মাত্র তিনটি আর্টিক্যাল পাই এ বিষয়ে। যদিও খুব স্বল্পসময়ে স্বল্পসংখ্যক করোনা আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলাদের ওপর এ রিসার্চগুলো করা হয়, তবুও এগুলো কিছুটা হলেও পথনির্দেশনা দেয়। যা এই মুহূর্তে খুবই প্রয়োজনীয়।

গবেষণাগুলো চীনের উহানের দুটি হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ওপর করা হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি ল্যান্সেটে অনলাইনে প্রকাশিত হুইজুন চ্যান ও তার সঙ্গীদের একটি গবেষণায় করোনা আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলাদের ক্লিনিক্যাল বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ/উপসর্গ, আউট-কাম বা ফল এবং জন্মের আগেই মায়ের কাছ থেকে শিশুর করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়। মাত্র ৯ জনের ওপর এ গবেষণাটি করা হয়। এই ৯ জন  জানুয়ারির ২০ থেকে ৩১ তারিখের মধ্যে তাদের গর্ভকালীন ৩৬-৩৭ সপ্তাহে হসপিটালে ভর্তি হন করোনা আক্রান্ত হয়ে। তাদের বয়স ছিল ৩৩ থেকে ৪০ এর মধ্যে।

গবেষণায় দেখা যায়, করোনা আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলাদের লক্ষণগুলো স্বাভাবিক প্রাপ্তবয়স্ক রোগীদের মতোই- জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, গলা ব্যথা, শরীর ব্যথা, ডায়রিয়া ইত্যাদি। এই রোগীদের কেউই খুব সিভিয়ার বা আশঙ্কাজনক অবস্থায় ছিলেন না। কেউ আইসিইউতে  ভর্তি ছিলেন না। ওই সময় তাদের কিছু টেস্ট করে দেখা হয় বাচ্চার মধ্যে করোনা সংক্রমণ হয়েছে কিনা। তবে সবার সিজার করতে হয়েছিল গড়ে ৩৯ সপ্তাহে যা নির্ধারিত সময়ের কিছুটা আগেই। সিজারের কারণ হিসেবে অন্যান্য উপসর্গের সঙ্গে স্বাভাবিক বা নরমাল ডেলিভারিতে শিশুর করোনা আক্রান্তের আশঙ্কাকে মাথায় রাখা হয়। আনন্দের বিষয় ৯ জন সুস্থ শিশুর জন্ম হয়েছিল। নবজাতক করোনা আক্রান্ত কিনা দেখার জন্য (neo-natal  throat  swab samples) টেস্ট করা হয়। সব টেস্টই নেগেটিভ আসে। জন্মের ৩৬ ঘণ্টা পর একটি শিশু করোনা আক্রান্ত হয়। কিন্তু তার ভাইরাস সংক্রমণ গর্ভে থাকা অবস্থায় হয়েছে নাকি জন্মের পর আক্রান্ত মায়ের সংস্পর্শে আসার কারণে হয়েছে তা প্রমাণিত নয়। অন্য আর একটি শিশু জন্মের ১৭ দিন পর করোনা আক্রান্ত হয়। সে করোনা আক্রান্ত মা ও নার্স দুজনের সংস্পর্শে এসেছিল। গত ২৪ মার্চ, ২০২০ সালে ল্যান্সেটে অনলাইনে আর একটি রিসার্চ স্টাডি প্রকাশিত হয়। ন্যান ইউ ও তার সঙ্গীরা অন্য আর এক হাসপাতালে ৭ জন করোনা আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলার ওপর এই রিসার্চটি করেন। তারাও ঠিক একই ধরনের লক্ষণ, ফল পান।  এই গবেষণায় চিকিৎসার দিকটি তুলে ধরা হয়। উপরে উল্লিখিত গবেষণাগুলো মূলত গর্ভকালীন ৩৬-৩৭ সপ্তাহের মহিলাদের ওপর করা হয় যারা ওই সময় হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল। প্রেগন্যান্সির প্রথম দিকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে কি ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে তা জানা যায়নি এখনো। তবে সুখের বিষয় কোনো আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলা মৃত্যুবরণ করেনি বা জন্মদানের পর করোনা আক্রান্ত কোনো মায়ের মৃত্যু হয়নি। কভিড-নাইনটিন বা করোনা আক্রান্ত প্রেগন্যান্ট মহিলাদের যে সব ব্যবস্থাপনা দেওয়া হয়-* আইসোলেশন * অক্সিজেন থেরাপি *মালটি ডিসিপ্লিনরই টিম এপ্রোচ-সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট দেওয়া হয়।

* নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ ব্যবহারের কথা উল্লেখ নেই। তবে ন্যান ইউ এর স্টাডিতে এনটি ভাইরাল আর এন্টিবাইওটিক্স ও সিজারের পর কর-টিকো স্টেরয়েড ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। তারা দুজন রোগীর ক্ষেত্রে চাইনিজ মেডিসিনের ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন যদিও এ ধরনের চিকিৎসার কোনো উপকারিতা প্রমাণিত নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রেগন্যান্ট মহিলাদের ক্ষেত্রে কর-টিকো স্টেরয়েড ব্যবহারের  কিছু বিধি নিষেধ দিয়েছে। মূলত প্রেগন্যান্ট মহিলাদের ক্ষেত্রে মেডিসিন ব্যবহারে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। উপরে উল্লিখিত গবেষণাগুলো ও বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী চীনের ন্যাশনাল হেলথ কমিশন করোনাআক্রান্ত গর্ভবতী মহিলাদের জন্য বিশেষ এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে। তাতে এ ধরনের রোগীদের ঘন ঘন ফলোআপ, কাউন্সিলিং, স্পেশাল প্রটেকটিভ পোশাক ও বিশেষ যত্ন নেওয়ার জন্য বলা হয়। জন্মের পর অন্তত ১৪ দিন নবজাতক বাচ্চাকে আইসোলেশনে রাখতে বলা হয়েছে এবং দুধপান না করাতে বলা হয়েছে।

যেহেতু খুব স্বল্পসংখ্যক রোগীর ওপর গবেষণাগুলো জরুরি ভিত্তিতে করা হয়েছে তাই আরও বেশি গবেষণা প্রয়োজন। আরও বেশি তথ্য-প্রমাণ দরকার নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে আসার জন্য। অতএব, আমরা এতটুকু আশাবাদী হতে পারি, করোনা আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলাদের নবাগত শিশু করোনা আক্রান্ত নাও হতে পারে এবং তারা কোনো রকম কমপ্লিকেশন নিয়ে নাও জন্মাতে পারে। শিশু জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তাকে অন্তত ১৪ দিন আইসোলেটেড রাখতে হবে। উপযুক্ত প্রটেকশন ব্যবস্থা না নিয়ে মাতৃদুগ্ধ পান করানো যাবে না। আমাদের সচেতনতাই বাঁচাতে পারে আমাদের ভবিষ্যৎ।

- লায়লা আরজুমান্দ, এ স্টুডেন্ট অব মাস্টার অব পাবলিক হেলথ, পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্ট, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি।

তথ্য : দি ল্যান্সেট  এ ১৩ ও ২৪ মার্চ ২০২০  তারিখে প্রকাশিত দুটি গবেষণা।

সর্বশেষ খবর