বেসরকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব প্রায় পাঁচ বছর ধরে পালন করছেন সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। চেয়ারম্যান হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি)। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ২৫ বছরে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের অর্জনগুলো কী কী?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান : ২৫ বছরে সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয় আমরা আস্থার প্রতীক হিসেবে থাকতে পেরেছি। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রির প্রথম পাঁচ/সাতটা ব্যাংকের নাম এলে এমটিবির নাম আসে। এ জন্য আমাদের বোর্ড, ম্যানেজমেন্টসহ ৩৫০০ কর্মীর প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকের পরিশ্রম থেকে আমরা এ আস্থার স্বীকৃতি অর্জন করেছি। গ্রাহকের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি বলেই তারা আমাদের ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন। আমার কাছে মনে হয়, এটাই আমাদের বড় অর্জন। এটা সম্ভব হওয়ার অন্যতম কারণ- আমরা সুশাসন মেইনটেইন করি। আমরা একটা প্রসেস অনুসরণ করি। এতে প্রতিষ্ঠানে যেই আসুক না কেন প্রতিষ্ঠান রান করবে। আমাদের দেশে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যাংকে সমস্যা হয়েছে। তারপরও কিছু ব্যাংক দাঁড়িয়ে আছে। এর অন্যতম কারণ হলো প্রসেস। সে হিসেবে বলা যায়, আমরা এখনো ভালো আছি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রবৃদ্ধি কতটা টেকসই?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান : আমরা ১০ ব্যাংকের একটি ব্যাংক, যারা সাসটেইনেবল পুরস্কার জিতেছি। তার কারণ হলো- সব রেশিওতে আমাদের অবস্থান ভালো রয়েছে। অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও বেশি। ৭৬ থেকে ৭৭ এ আছে। লিকুইডিটি কাভারেজ রেশিওতে প্রায় ১৬০ শতাংশ রয়েছে। এ রেশিওগুলো আমাদের খুব স্ট্রং। এ ছাড়া আমাদের প্রসেসটা তো রয়েছে। এগুলো আমাদের অন্যান্য ব্যাংক থেকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনাদের ঋণ এবং আমানতের পরিস্থিতি কেমন?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান : আমাদের আমানত প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। ঋণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। আমাদের খেলাপি ঋণ একটু বেশি। সাড়ে ছয় শতাংশের মতো। আমাদের ২০১৪, ১৫, ১৬ এ তিন বছর কিছু ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটার জন্য আমি বোর্ডকে দায়ী করব না। এটা আমাদের সিলেকশন ছিল। সেটা হয়তো ভুল ছিল। সেগুলো আমরা এখন ক্লিনআপ করছি। ব্যালান্স শিট দেখলে দেখা যাবে, গত দুই বছরে আমরা ৮০০ কোটি টাকা বিতরণ করেছি। এ বছরও আমরা প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছি। গত পাঁচ বছরে আমাদের খেলাপি ঋণ মাত্র ১.২ শতাংশ।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : প্রযুক্তিভিত্তিক ও কনজুমার ব্যাংকিংয়ে আপনাদের অবস্থান কী?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান : অটোমেশন কিংবা ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা শুরুর দিকে থাকব। কেউ যদি ডিজিটাল পণ্যের কথা চিন্তা করে, টেলকো বা ফিনটেকের কথা চিন্তা করলে তারা আমাদের কথা চিন্তা করে। আমরা অত বেশি লোক নেইনি। তবে কিছু লোক আমাদের আছে যারা কঠিন পরিশ্রম করেন। আমাদের ব্যাংকিং যে অ্যাপস আছে তা মার্কেটের অন্যতম সেরা ফাংশনাল অ্যাপ। এ অ্যাপের মাধ্যমে দৈনন্দিন যা যা করা লাগে সব করা সম্ভব। আমরা এটাকে সুপার ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাপ হিসেবে পুনরায় উদ্বোধন করব।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি এখন কেমন?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান : সর্বশেষ ফিগারে গ্রোথের বিষয়ে বলা নেই। এটা গ্লোবাল সিনারির ব্যাপার ছিল। লোকালি মুদ্রাস্ফীতি ছিল অনেক বেশি। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করার সময় টাকার অনেক অবমূল্যায়ন হয়েছে। কিছু কিছু ব্যাংকের লিকুইডিটি ভালো। তবে সার্বিকভাবে চাপ আছে। গ্লোবাল সিনারিও এর কারণে দেখা যায়, জিনিসপত্র ঠিকমতো বিক্রি হচ্ছে না। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরেকটু সমস্যা হচ্ছে। মেগা প্রজেক্টগুলো হলটেড। সব কিছু মিলিয়ে আমাদের ক্রেডিট গ্রোথ একটু স্থবির হয়ে আছে। গত এক সপ্তাহে মনে হয়েছে পরিস্থিতি একটু অনুকূলে এসেছে। আমার মনে হয়, এ বছর একটু স্লো যাবে। অনেক ইস্যু আছে। আগামীতে হয়তো আমরা ভালো সময় পার করব। মধ্যপ্রাচ্যে সংকটে তেলের বাজারে অস্থিরতা। গার্মেন্টে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের মতো উৎপাদন ক্ষতি হয়েছে। এসব একটু অস্থিতিশীল করে রেখেছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : সুদহার কি বাড়তেই থাকবে?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান : ২০২০ সালের এপ্রিলে সুদ হারের সীমা আরোপ করা হয়েছিল। এগুলো অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়নি বরং আরও পিছিয়ে দিয়েছে। ৯০ দশকের মাঝামাঝিতে কিছুটা রিফর্ম হয়েছে। সে রিফর্ম না করে ১০/১১ সালে পিছিয়ে যাচ্ছিলাম। ২০০৮/২০০৯ সালে আমাদের খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। তা এখন ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। হিসাব করলে আরও বাড়বে। এ সরকার এসে পর পর দুই ধাপে পলিসি রেট বাড়িয়েছে। যেহেতু আমরা ঠিকসময়ে সিদ্ধান্ত নেইনি। হয়তো সুদহার আরও বাড়বে। আগামী বছর মাঝামাঝিতে আবার কমে আসবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ডলারের দর কি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান : আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ ফরেন এক্সচেঞ্জ বাড়াতে হবে। আমাদের রেমিট্যান্স ভালো কাজ করছে। গত মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি এসেছে। এটা ভালো বিষয়। সামনের সময় যদি আমাদের রেমিট্যান্স সাস্টেইন থাকে, ইমপোর্ট পেমেন্টটা যদি রিজনেবল রাখতে পারি তাহলে এ সেক্টরের জন্য ভালো হবে। এখন হুন্ডি কমে গেছে। মেজর হুন্ডি বন্ধ হয়েছে। এটা সবচেয়ে স্বস্তির খবর। এ অবস্থা ধরে রাখতে পারলে সামনে আরও উন্নতি হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : গ্রিন ফাইন্যান্সিংয়ে আপনাদের অবদান কেমন?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান : বাংলাদেশ হলো অন্যতম কøাইমেট ভঙ্গুর দেশ। স্বাভাবিকভাবে সরকার থেকে এ ধরনের অনেক কাজ হচ্ছে। সম্প্রতি আমাদের সুপার শপে পলিথিন বন্ধ হয়েছে। রাস্তায় হর্ন বাজানো বন্ধ হচ্ছে। কাজ হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও এ বিষয়ে ফান্ডিং হচ্ছে। প্রত্যেক ব্যাংক চেষ্টা করছে গ্রিন ফাইন্যান্সিং বাড়ানোর। আমরা সাসটেইনেবল যে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি তার অন্যতম কারণ হলো গ্রিন ব্যাংকিং।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : সিএসএমই ফাইন্যান্সিংয়ে আপনাদের পরিস্থিতি কেমন?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান : সিএসএমই ফাইন্যান্সিংয়ে আমরা বাংলাদেশের টার্গেটের ৮০ শতাংশ অর্জন করেছি। ২০ শতাংশ জায়গায় আমরা পিছিয়ে আছি। এ জায়গায় আমাদের কাজ করতে হবে। ডাইরেক্ট লেন্ডিং টু ফারমার এ জায়গায় একটু পিছিয়ে আছি। এ ছাড়া অন্যান্য জায়গায় আমাদের অবস্থান ভালো আছে। আমাদের পোটফোলিওর ১০ থেকে ১২ শতাংশ এসএমই। আমরা চেষ্টা করছি এটাকে ২০ শতাংশে নিতে। আমরা সিএসএমইতে ট্রেডিশনালের বাহিরে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে ফোকাস করছি। এ জন্য আমরা ফিনটেক পার্টনারের সঙ্গে পার্টনারশিপ করে এগিয়ে যেতে চাচ্ছি। এটা আমাদের হেল্প করবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ভবিষ্যতে এমটিবিকে কোথায় দেখতে চান?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান : আমাদের পরিচালনা পর্ষদের স্বপ্ন এমটিবিকে একটা সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া। একটা আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা। এ ব্যাংকের সুনাম শুধু দেশে নয় বিদেশেও থাকবে। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা সবসময় ছিল আছে ভবিষ্যতেও থাকবে। আমাদের যারা সহকর্মী রয়েছেন তারা সবসময় সেবা দেওয়ার জন্য পজিটিভ থাকবেন। সে কাজটা আমরা শীর্ষ পর্যায় থেকে নিচ স্তর পর্যন্ত করতে চাই।