পানামা পেপারস বিশ্বের পরাক্রমশালী রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের পাশাপাশি বিত্তশালী খেলোয়াড় ও চিত্রতারকাদের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস করার পর নড়েচড়ে বসেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, নিউজিল্যান্ড, ভারতসহ কয়েকটি দেশ এসব ঘটনার তদন্ত করার ঘোষণা দিয়েছে।
সম্প্রতি মোসাক ফনসেকা নামের পানামার একটি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ফাঁস হওয়া নথিতে বিশ্বের শতাধিক ক্ষমতাধর মানুষ বা তাঁদের নিকটাত্মীয়দের বিদেশে টাকা পাচার করার তথ্য পাওয়া গেছে। বিশ্বের যেসব প্রতিষ্ঠান গোপনীয়তা রক্ষার জন্য বিখ্যাত, মোসাক ফনসেকা সেগুলোর একটি। পানামার এ প্রতিষ্ঠানের অজস্র নথি ফাঁসের এ ঘটনা ‘পানামা পেপারস’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।
মোসাক ফনসেকার সম্পদশালী ৮০০ মক্কেলের বিষয়ে এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়া। ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসও তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে। স্পেনের বিচার বিভাগীয় সূত্র জানায়, স্পেন এরই মধ্যে আইনি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ পাচার-বিষয়ক তদন্ত শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে তদন্তে মাঠেও নেমে পড়েছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশের রাজস্ব বিভাগ।
কেলেঙ্কারির ঘটনার কারণে আলোচিত পানামাও বিষয়গুলো তদন্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। জানিয়েছে, যদি কোনো অপরাধ হয়ে থাকে এবং আর্থিক ক্ষতি হয়ে থাকে, আর তা প্রমাণিত হয়, তাহলে পুরস্কৃত করা হবে। পানামার প্রেসিডেন্ট জুয়ান কার্লোস বলেছেন, আন্তর্জাতিক তদন্তে পানামা সহযোগিতা করবে। একই সঙ্গে তিনি দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজে জানিয়েছে, ফাঁস হওয়া গোপনীয় নথিপত্রের মধ্যে প্রথম দিন উন্মুক্ত হওয়া তথ্যে মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক, লিবিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান মুয়াম্মার গাদ্দাফি, সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ, ইরাকের সাবেক অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী আয়াদ আলাওয়ি, আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট ও আবুধাবির আমির খালিফা বিন জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান, হোসনি মোবারকের ছেলে আলা মুরাবক, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেনকো, ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট পাবলো রোজারিঙ্কো, আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমান্ডার গানলাউগন, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মৌরিসিও মারসি, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বাল্যবন্ধু ও বর্তমান সার্বক্ষণিক ঘনিষ্ঠ সহযোগী, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের বাবা ইয়ান ক্যামেরন, চীনের প্রেসিডেন্ট ঝি জিনপিংসহ ক্ষমতাসীন চায়না কমিউনিস্ট পার্টির আট শীর্ষ নেতার পরিবারের সদস্য, চীনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লি পেংয়ের মেয়ে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের তিন ছেলে-মেয়ে, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের ছেলে, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার ভাতিজা, জর্জিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিনজিনা ইভানিশভিলি, জর্ডানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলি আবু আল রাঘেব, কাতারের সাবেক আমির হামাদ বিন খালিফা আল থানি, কাতারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হামাদ বিন জাসিম বিন আল থানি, সুদানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমাদ আলি আল মিরঘানি, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলহাম আলিয়েভের স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে, মরোক্কোর রাজা পঞ্চম মোহাম্মদের একান্ত সহকারী বা পিএস, ঘানার সাবেক প্রেসিডেন্ট জন আগেকুম কুফুরের ছেলে, মেক্সিকোর বর্তমান প্রেসিডেন্ট এনরিক পেনা নিয়েতোর পিএস, স্পেনের সাবেক রাজা জুয়ান কার্লোসের বোন, আইভরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট লরেন্ট ঘাবোর পিএস, গিনির সাবেক প্রেসিডেন্ট লানসানা কোনতের স্ত্রী, ফিলিস্তিনের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মুস্তাফা, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন আবদুল আজিজ আল সৌদসহ অন্যান্য রাষ্ট্রনেতাদের অর্থ পাচার, কর ফাঁকি ও নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর কৌশল প্রকাশ পেয়েছে।
তালিকায় আরও আছেন ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী জেরোমি চাহুজাক, আইসল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী জারমি বেনেদিকসন, আইসল্যান্ডের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওলভ নরডাল, মাল্টার স্বাস্থ্য ও জ্বালানি মন্ত্রী কোনরার্ড মিজ্জি, ইকুয়েডরের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পেড্রো দেলগাডো, কেনিয়ার উপপ্রধান বিচারপতি কল্পনা রাওয়াল, ইকুয়েডরের অ্যাটর্নি জেনারেল গালো চিরিবোগা, গ্রিসের প্রধানমন্ত্রীর দফতরের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ পাপাসতাভরো, ইউকে হাউস অব লর্ডসের সদস্য ব্যারোনেস পামেলা শার্পলেস, ইউকে কনজারবেটিভ পার্টির সাবেক ডেপুটি প্রেসিডেন্ট মাইকেল অ্যাশক্রোফট, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য মাইকেল মেটস, পেরুর গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান সিজার আলমিয়েদা, আলজেরিয়ার শিল্পমন্ত্রী আবদেসলাম বাউচাওরেভ, অ্যাঙ্গোলার পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী মারিয়া ভাসকেনসেলস, আর্জেন্টিনার মেয়র নেস্তর গ্রিনদেত্তি, কম্বোডিয়ার বিচারমন্ত্রী অংভং ভাথানা, বোস্তানার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল আইয়ান কিরবি, কঙ্গোর জ্বালানি মন্ত্রী ব্রুনো রিচার্ড, নাইজেরিয়ার তেলসমৃদ্ধ ডেল্টা প্রদেশের গভর্নর জেমস আইবোরি, রুয়ান্ডার গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান ব্রিগেডিয়ার ইমানুয়েল দাহিরো, কঙ্গোর এমপি কাবিলা কংগু, কাজাখাস্তানের মেয়র নুরালি আলিয়েভ, পানামার সরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান রিকার্ডো ফ্রাঙ্গোলিনি, হাঙ্গেরির এমপি জোল্ট হারভার্থ, পোল্যান্ডের রাজনৈতিক দলের সভাপতি পাওয়েল পিসকরেস্কি, জাম্বিয়ার সাবেক রাষ্ট্রদূত আত্তান সানসোঙ্গা, ভেনিজুয়েলার সেনাপ্রধান ভিক্টর ক্রুজ ওয়েফার প্রমুখ।
আইসিআইজের তথ্যানুসারে, নাম প্রকাশ করা হয়নি এমন একটি সূত্র থেকে মোস্যাক ফসনেকার এই এক কোটি ১৫ লাখ নথি জার্মান দৈনিক সুইডয়চে সাইটংয়ের হাতে আসে। এরপর সুইডয়চে সাইটং সেসব নথি ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসকে (আইসিআইজে) দেয়। আইসিআইজের কাছ থেকে সেসব নথি পায় বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ ৭৮টি দেশের ১০৭টি সংবাদমাধ্যম। এখনো চলছে এসব নথির বিশ্লেষণ। সম্পদের তথ্য গোপন রেখে কর ফাঁকি দিতে মোস্যাক ফসনেকা কীভাবে হোমরা-চোমরাদের সহযোগিতা দিয়ে আসছিল, তার বিবরণ পাওয়া এসেছে এসব নথিতে। মোস্যাক ফসনেকার পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘আমরা দীর্ঘ ৪০ বছর মানি লন্ডারিংবিরোধী আইন মেনে চলছি। সেদিকে খেয়াল রেখেই আমরা ক্লায়েন্টদের সেবা দিয়েছি। নিজেদের সেবার যে কোনো ধরনের অপব্যবহার রোধেও আমরা সচেষ্ট ছিলাম। এ কারণে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি আমরা হয়নি।’
ভারতের পাঁচ শতাধিক নাম : ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, নথিপত্রে পাঁচ শতাধিক ভারতীয় ব্যক্তির নাম রয়েছে। এর মধ্যে আছে বলিউড তারকা অমিতাভ বচ্চন, ঐশ্বরিয়া রাই, ডিএলএফ স্বত্বাধিকারী কেপি সিং ও তার পরিবারের আরও ৯ সদস্য, অ্যাপোলো টায়ারস, ইন্ডিয়ান বুলস থেকে আদানি গ্রুপের গৌতম আদানি ও তার বড় ভাই বিনোদ আদানির নাম। দুই রাজনৈতিক ব্যক্তির মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শিশির বাজোরিয়া ও লোকসত্তা পার্টির দিল্লি ইউনিটের সাবেক প্রধান অনুরাগ কেজরিওয়ালের নাম। ‘পানামা পেপারস’-এর তালিকায় মুম্বাইয়ের ডন ইকবাল মিরচি থেকে শুরু করে পাঞ্চকুলা, দেহরাদুন, ভাদোদারা ও মান্দাসুরের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর নাম-ঠিকানাও রয়েছে। অবশ্য মোট ২৩৪টি ভারতীয় পাসপোর্ট ও ৩৬ হাজার নথিতে এমন নামও আছে, যার আসলে কোনো অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে গতকাল বিকেলেই নিজেদের কর ফাঁকির তথ্যে প্রতিবাদ জানিয়েছেন অমিতাভ বচ্চন ও ঐশ্বরিয়া রাই।
মেসি, প্লাতিনি ও ফিফার শীর্ষ কর্তারা : ফাঁস হওয়া গোপন নথিতে বিশ্বের বহু হোমরা-চোমরার সঙ্গে পাওয়া গেছে ফুটবলার লিওনেল মেসির নাম। মেসি ও তার বাবা হোর্হে হোরাসি ২০১২ সালে মোস্যাক ফসনেকায় নিবন্ধিত ‘মেগা স্টার এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি কোম্পানির চূড়ান্ত সুবিধাভোগী মালিক। অবশ্য শুধু মেসিই নন, তালিকায় আছেন সাবেক খ্যাতনামা ফুটবলার ও ফিফা কর্মকর্তা মিশেল প্লাতিনি। এ ছাড়া ফিফার বেশ কয়েক জন কর্মকর্তার নামও রয়েছে ফাঁস হওয়া দলিলে।
বিডি-প্রতিদিন/০৫ এপ্রিল, ২০১৬/মাহবুব