দুর্নীতি ও কালো রুপির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করতেই গত ৮ নভেম্বর মধ্যরাত থেকেই ৫০০, ১০০০ রুপির নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আচমকা এই ঘোষনার পরই সঙ্কটে পড়ে যান দেশটির কোটি কোটি সাধারণ মানুষ। নোট বাতিলের ঘোষনার সঙ্গে সঙ্গেই পরপর দুইদিন দেশের সমস্ত এটিএম কাউন্টার ও একদিন বন্ধ রাখার ঘোষনাও দেওয়া হয়। আর তাতেই সমস্যা আরও চরমে ওঠে। একদিকে ঘরে পুরোনো নোটের পাহাড়, অন্যদিকে খুচরোর আকাল। নোট বাতিলের ফলে দেশজুড়ে অঘোষিত হরতালের চেহারা নেয়। বাণিজ্য নহরী মুম্বাই থেকে শুরু করে দিল্লি, কলকাতা, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, কাশ্মীর-সব জায়গাতেই এক সমস্যা। খুচরো সমস্যার কারণে বাজারে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছে অনেককে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি হয়রানির শিকার হতে হয় ভারতে আসা অসংখ বিদেশি পর্যটকদেরও। তাদের কেউ বেড়াতে কেউ বা আবার আসেন চিকিৎসার কারণে। কিন্তু ডলার-ইউরো-বাংলাদেশি টাকা থেকে ভারতীয় মুদ্রায় পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। দেশের প্রায় সব মানি এক্সচেঞ্জ অফিসগুলি রাতারাতি ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়। ফলে অনেককেই ভ্রমণ কিংবা চিকিৎসা থামিয়ে মাঝপথেই দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন।
সরকারের নোট বাতিল ইস্যুকে হাতিয়ার করেই ভারতের রাজনীতিও উত্তাল হয়ে ওঠে। মোদির ‘ডিমানিটাইজেশন’-এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সরব হয় পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্যজুড়ে মিছিল, জনসভা করার পাশাপাশি দলের ভারত জুড়েও এই আন্দোলনের ঝড় পৌঁছে দিতে দিল্লি, পাটনা ও উত্তরপ্রদেশেও সভা করেন দলনেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। চুপ করে বসেছিল না কংগ্রেস, সিপিআইএম, বিএসপি, এসপি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল সহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলিও। উত্তপ্ত হয়েছে রাজপথ, উত্তাল হয়েছে সংসদ। দিনের পর দিন মুলতবি হয় সংসদের অধিবেশন। এই ইস্যুতে গত ২৮ নভেম্বর হরতাল পালন করে বাম দলগুলি। অন্যান্য দলগুলি সারাদেশে আক্রোশ দিবস পালন করে। রাজনৈতিক দলগুলির পাশাপাশি বেশকয়েকটি সংগঠনের তরফেও এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে প্রতিবাদ দেখানো হয়।
যদিও নোট বাতিলের ইস্যুতে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মোদির পাশে দাঁড়ান বিরাট কোহলি, অনিল কুম্বলে, অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, সালমান খান, রজনীকান্ত, অভিষেক বচ্চন ও তাঁর স্ত্রী ঐশ্বর্যা রাই বচ্চন, অনুপম খের, আলিয়া ভাটসহ বিভিন্ন জগতের বিশিষ্টরা। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে দাবি করা হয় এই সিদ্ধান্তে দেশের মানুষও তাদের পাশেই রয়েছে। এমনকি একাধিক জায়গায় সভা করে নোট বাতিল ইস্যুতে কংগ্রেস সহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে তোপ দেগে মোদি জানান সাধারণ মানুষের কোন সমস্যায় হয় নি, যারা কালো রুপির কারবারীরাই আমার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। সমস্যা সমাধানে দেশবাসীর কাছে ৫০ দিন সময় চেয়ে নিয়ে মোদি জানান গত ৭০ বছর ধরে দেশে যে দুর্নীতি চলে আসছে তা হয়তো এই ৫০ দিনে মেটানো সম্ভব নয়। নগদে লেনদেন কমিয়ে ক্যাশলেস সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলারও ডাক দেন প্রধানমন্ত্রী।
নোট বাতিল ঘোষণার এক মাসের মাথায়ও সেই সমস্যা এখনও মেটেনি। কালো রুপি সাদা করতে কেউ কেউ হয়তো পুলিশের হাতে আটক হয়েছে, বহু জায়গায় ছেঁড়া-ফাঁটা কোটি কোটি বাতিল নোটের হদিশও মিলেছে কিন্তু দেশজুড়েই এখনও রুপির সঙ্কট অব্যাহত। দেশের একাধিক এটিএম কাউন্টারে ‘নো ক্যাশ’ নোটিশ ঝোলানো। রুপি থাকলেও প্রতি কার্ডে ২৫০০ রুপির বেশি মিলছে না। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর পর এটিএম-এ ঢুকতেই শুনতে হচ্ছে ‘রুপি শেষ, আজ আর হবে না’। ব্যাঙ্কেও প্রতি সপ্তাহে ২৪ হাজার রুপির বেশি দেওয়া হচ্ছে না। এটিএম’এর বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে সারা দেশে এখনও পর্যন্ত ৮০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ। এই ইস্যুতে বুধবারও দেশটির সংসদ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এদিন লোকসভার অধিবেশনের শুরুতেই সরকারকে চেপে ধরে বিরোধীরা। লোকসভায় বিরোধী দলনেতা কংগ্রেস সাংসদ গুলাম নবি আজাদ অভিযোগ করেন নোট বাতিলের ফলে দেশে এক মাসের মধ্যেই ৮৪ জন নিহত হয়েছে। কোনরকম পরিকল্পনা ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তাই সাধারণ মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এই ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর দাবিও জানায় বিরোধীরা। পাল্টা জবাব দেয় সরকার পক্ষও। অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলি বলেন বিরোধীদের দাবি মেনে সংসদে প্রধানমন্ত্রী হাজির ছিলেন কিন্তু তারা আলোচনায় রাজি হল না। আসলে বিরোধীদের লক্ষ্যই হল যেতেন প্রকারে অধিবেশন ভুণ্ডুল করে দেওয়া।
এদিন বুধবারও মোদির বিরুদ্ধে সরব হয়েছে মমতা। ট্যুইট করে মমতা জানান, ‘মোদি বাবুর জন্য আর কত মানুষকে প্রাণ দিতে হবে?’
বিডি-প্রতিদিন/ ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৬/ আফরোজ