নারীর অধিকার বলে কিছু নেই পাকিস্তানে। করোনার প্রকোপ থামলে পাকিস্তানের নারীরা আরও ভয়ঙ্কর দানবিক নর-হিংসার শিকার হতে চলেছেন। বর্তমান পরিস্থিতির ওপর দাঁড়িয়ে আর সংখ্যালঘু নারী ও শিশুদের জন্য থাকছে আরও ভয়ঙ্কর অত্যাচারেক আশঙ্কা। এমনটাই মনে করছেন সে দেশের নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। খোদ পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশনের পর্যবেক্ষণ, 'পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক'। সদ্য প্রকাশিত সরকারি তথ্যেই ধরা পড়েছে ২০১৯ সালে নারী ও শিশুদের ওপর অত্যাচারে ভয়ঙ্কর চিত্র। চলতি বছরে করোনার দাপটে সেই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কার কথাই বলছেন সেখানকার নাগরিকরা।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর সেই দুর্বিসহ দিনগুলোর পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে খোদ পাকিস্তানের মাটিতে। বাংলার মাটিতে লক্ষ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত সেই সময় লুণ্ঠিত হয়। এখন ঠিক সেরকমভাবেই অন্ধকার দিন ঘনিয়ে আসছে পাকিস্তানের মাটিতে। পাক-সেনাদের পাশাপাশি ধর্মীয় নেতারা নারী ও শিশুদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন। সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ১১ জন নাবালিকা সেখানে যৌন হেনস্থার শিকার। ধর্ষণ, সম্মানরক্ষায় খুন ও স্ত্রী নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা। গ্রামাঞ্চলে নারী শিক্ষার বালাই নেই। বাংলাদেশের তুলনায় নারীর ক্ষমতায়নের কোনও উদ্যোগই চোখে পড়ছে না ইমরান খানের দেশে। পরিকাঠামোই তৈরি হয়নি শিক্ষা বিস্তারে। বাল্য বিবাহ রোধেও নেই কোনও প্রয়াস। বরং ধর্মীয় নেতা ও সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল পাকিস্তান সরকার নারীদের পর্দানশীল হয়ে থাকতে বাধ্য করছে। কোনও স্বাধীনতা নেই পাকিস্তানের নারীদের। প্রতিবাদ করতে গেলেই নেমে আসছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। খ্রিস্টান বা হিন্দু হলে তো কথাই নেই। নির্মম অত্যাচারের কাহিনী উঠে এসেছে এইচআরসিপি বা পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশনের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে।
সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, পাকিস্তান মানবাধিকার লুণ্ঠনের বাস্তব ছবি। এইচআরসিপি-র মুখপাত্র আই এ রহমান সাংবাদিকদের বলেন, 'মানবাধিকারের প্রশ্নে ২০১৯ ছিল অত্যন্ত উদ্বেগের। ২ হাজার ৮৪৬টি শুধুমাত্র শিশুদের যৌন হেনস্থার অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। অনথিভুক্ত অত্যাচারের সংখ্যা আরও বেশি।' প্রতিবেদনে উঠে এসেছে পারিবাকির সম্মান রক্ষার নামে 'সম্মানরক্ষায় খুন' বা অনার কিলিং থেকে শুরু নারী হত্যার ভয়ঙ্কর চিত্র। পুলিশ ও বিচার বিভাগও যে অসহায় নারীদের প্রতি সহমর্মিতা দেখায়নি সেটাও স্পষ্ট মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে। কমিশনের পরিচালক হারিস খালিকের পর্যবেক্ষণ, পাকিস্তানে মানুষের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। মিডিয়াকে সঠিক পথে চলতে দিচ্ছে না সরকার। নেমে আসছে নানাবিধ জুলুম। সাংবাদিকরাও মৌলবাদী ও সেনাকর্তাদের হাতে নিগৃহিত হচ্ছেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন বর্তমান পরিস্থিতির। লকডাউনে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
জেনারেল জিয়া-উল-হকের সময় থেকেই পাকিস্তানে নারীদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে বলে পাক-নারীবাদীদের বিশ্বাস। এখনও সেই ধারা চলছে। পাকিস্তান জুড়ে শুরু হয়েছে পবিত্র কোরানেরও অপব্যাখ্যা। মৌলবাদীরা বলছেন, নারী হয়ে জন্মানোটাই 'আসলি গুনা'। নারীদের অপশক্তি বলেও ব্যাখ্যা করা হচ্ছে প্রকাশ্যে। অথচ বিশিষ্ট পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী মৌলানা জাফর শাহ ফুলওয়ারি ১৯৫৫ সালে বলেছিলেন, 'ইসলাম ধর্ম অগাধ স্বাধীনতা দেয় নারীদের। তাই তো স্বামী নির্বাচনে নারীরাই বড় ভূমিকা নেন। তার মতে, ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী নারীরা রান্না বা ঘর-গৃহস্থলির কাজে বাধ্য নন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে পুরো বিপরীত ছবি।
সারা পাকিস্তান নারী পরিষদ (এপিডব্লিউএ)-এর মতে, পাকিস্তানের মাটিতে নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছেই না। শহরাঞ্চলে কিছুটা অধিকার ভোগ করলেও গ্রামাঞ্চলে পরিস্থিতি ভয়াবহ। গোটা দেশের প্রশাসনিক বা ম্যানেজিরিয়াল কাজকর্মে ০.৮ শতাংশ অংশগ্রহণও নেই নারীদের। পুরুষরা পাশ্চাত্যে উন্নত পেশার সন্ধানে চলে যাওয়ায় দিন দিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। নারীদের সংসার চালানোর দায়ে নিজেদের যৌন পেশায় সঁপে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। বাড়ছে শিশু যৌনকর্মীর সংখ্যাও। বহু শিশু মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে এইডসসহ অন্যান্য যৌন রোগাক্রান্তের সংখ্যাও। নারীবাদী কবি কিশোর নাহিদের অভিযোগ, পাকিস্তানের গ্রামীণ এলাকার নারীদের জাতীয় পরিচয় পত্রই দেওয়া হচ্ছে না। ফলে ভোটাধিকারই শুধু নয়, শিক্ষা থেকে শুরু বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছেন। মিলছে না ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার অধিকারও। অর্থাৎ পাকিস্তানের গ্রামীণ এলাকার বহু নারী নাগরিক বা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ১৯৫৬ থেকেই তাই পাকিস্তানের ভোটে নারীদের অংশগ্রহণের হার অত্যন্ত নৈরাজ্যজনক। নারীদের ক্ষমতায়নের প্রশ্নে শিয়া ও সুন্নি দুই সম্প্রদায়ের অবস্থানই বেশ নেতিবাচক।
পাকিস্তানে নারীর ক্ষমতায়নের ছবিটা রুখসান্দা নাজের লড়াই দেখলেই স্পষ্ট হবে। নাজ এখন পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনকোয়ায় ঔরত ফাউন্ডেশনের আবাসিক পরিচালক।
একজন আইনজীবীও। জাতিসংঘের হয়েও কাজ করেন। কিন্তু এই জায়গায় উঠে আসতে কম লড়াই করতে হয়নি তাকে। ১২ ভাইবোনের মধ্যে ছোট নাজকে ১৫ বছর বয়সেই বিয়ে দিতে চেয়েছিল তার দাদা। কিন্তু পড়াশুনোর প্রতি বাড়তি আগ্রহ থাকায় তাকে খুন করার চেষ্টাও হয় পরিবার থেকেই। অনেক কষ্টে আইন পাশ করে মেয়েদের অধিকার নিয়ে আফগান সীমান্তে লড়াই চালাচ্ছেন নাজ। তার সাফকথা, পাকিস্তানে নারীদের কোনও অধিকার নেই। এমনকী, নিজের মাকে খুন করতেও হাত কাঁপে না ধর্মান্ধদের। লাহোরের সাইমা জাসমের কাহিনী আরও করুণ। তার চোখের সামনেই বাবা-মা খুন হন ধর্মান্ধদের হাতে। ঘাতকদের সন্দেহ ছিল, সাইমার বাবা-মা হিন্দু। তাই খুন। সাইমা মানুষ হন হিন্দুদের পরিবারে। পরে প্রেমে পড়েন এক মুসলিমের। তাই বিয়ের জন্য বাধ্য হন মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করতে। পাকিস্তানে জোড় করে ধর্মান্তর নতুন কিছু নয়। সঙ্গে চলছে পুরোদমে লাভ জিহাদ। ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়ে তারপর তাদের পতিতালয়ে পাচারের ঘটনাও কম নেই। বহু ইমাম বা মৌলভিরাও যৌন হেনস্থার অপরাধে অভিযুক্ত।
পাকিস্তানে নারীদের অধিকার আদায়ে ১৯৮১ সালে স্থাপিত হয় ওমেনস অ্যাকশন ফোরাম। ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তারা আন্দোলনে নামেন। শুরু হয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। নারীর অধিকার লড়াইয়ে কালা দিবস নেমে আসে পাকিস্তানে। পাকিস্তানে জিয়ার আমলে লাগু হয় ধর্মনিন্দা বিষয়ক আইন। এই আইনের ফলে বহু সংখ্যালঘু এখন জেলের কুঠুরিতে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। নারীরাও রেহাই পাচ্ছেন না এই দানবিক আইনের হাত থেকে। শুধু নারীরা কেন, পাকিস্তানে হিজড়াও স্বস্তিতে নেই মোটেই। ২০১৮ সালে সরকারি রেকর্ড বলছে ৪৭৯টি হিজড়াদের ওপর আক্রমণ সংগঠিত হয়। এরমধ্যে মারা যান অন্তত ৫৭ জন। পাকিস্তানের ফয়সলাবাদে ২০১৮ সালের প্রথম ৬ মাসেই ৬৬ জন নারী খুন হন। লাহোরে শিশু ধর্ষণের মামলা দায়ের হয় ১৪১টি। মুভমেন্ট ফর সলিডারিটি অ্যান্ড পিস ইন পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতি বছর হাজার খানেক নারী শুধুমাত্র পারিবারিক সম্মান রক্ষার নামে খুন হচ্ছেন। হাজার হাজার হিন্দু নারী বাধ্য হচ্ছেন মুসলিমকে বিয়ে করতে। বাড়ছে শিশু বিবাহও।
পাকিস্তানের ন্যাশনাল কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অব উমেন-এর চেয়ারম্যান খাওয়ার মুমতাজের দেওয়া তথ্য অনুয়ায়ী, পাকিস্তানের ১৮ শতাংশেরও বেশি শিশুকন্যার ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। ২১ শতাংশের হয় ১৮ বছরের আগে। তবে বাস্তবে গ্রামাঞ্চলের ছবিটা আরও ভয়ঙ্কর। গ্রামাঞ্চলে অন্তত ৫০ লক্ষ ছেলেমেয়ের পড়াশুনোর মতো পরিকাঠামোই নেই। এই কারণে নারীরাই বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার সুযোগ থেকে। পাকিস্তান হিন্দু কাউন্সিলের সভাপতি রমেশ কুমার বনকুয়ামির অভিুযোগ, হিন্দু বা খ্রিস্টান ছেলেমেয়েরা কোনও সুযোগই পাচ্ছে না। জুটছে কেবল অত্যাচার। করোনা পরবর্তীতে হিন্দু বা খ্রিস্টানদের আরও দুর্ভোগ পোহাতে হতে পারে। বাংলাদেশের মতো পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের জন্য কোনও সরকারি বা বেসরকারি ব্যবস্থাই নেই। রয়েছে শুধু জুলুম। কাজীরাও হিন্দু নারীদের বাধ্য করছেন মুসলিমদের বিয়ে করতে। পুলিশ বা প্রশাসনও কাজীদের সঙ্গে একই অপকর্মের শরিক।
সবমিলিয়ে পাকিস্তানের নারীদের অবস্থা ভয়াবহ। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা পরবর্তীতে পাকিস্তানের অর্থনীতি আরও বিপর্যস্ত হবে। বহু মানুষ কাজ হারাবেন। তখন নারীদের অবস্থা আরও দুর্বিসহ হবে। সেনা ও ধর্মীয় নেতাদের হাতের পুতুল ইমরান খানের সরকার সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে কোনও পদক্ষেপই নিচ্ছে না। আগামী দিনেও যে নেমে তার কোনও ইঙ্গিত নেই। তাই বাংলাদেশের ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মতোই পাকিস্তানের নিজেদের মাটিতেও নারীরা আজ দানবিক নর-হিংসার শিকার।
বিডি-প্রতিদিন/শফিক