শিরোনাম
৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ১২:৪০
সাইমন ড্রিংয়ের লেখা

অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্নে ঢাকায় ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংস গণহত্যার বিবরণ

অনলাইন ডেস্ক


অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্নে ঢাকায় ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংস গণহত্যার বিবরণ

অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর সেনারা ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংসভাবে খুন করেছে সাধারণ মানুষদের। ১৯৭১-এর মার্চে ঢাকায় নিজের অভিজ্ঞতা এভাবেই ব্যক্ত করেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন জন ড্রিং। তিনি আজও ভুলতে পারেননি 'অপারেশন সার্চলাইট'-এর নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতার কথা। পাক-সাঁজোয়া বাহিনী কীভাবে ঢাকা-সহ গোটা পূর্ব পাকিস্তানকে ঠান্ডা মাথায় মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছিল সেটাই উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। ড্রিং নিজেই এক রাতে ৭ হাজার মানুষ হত্যার সাক্ষী। নৃশংসতার মাধ্যমে পাকিস্তান একটি দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধংস করতে চেয়েছিল। পাক-সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান বিশ্ববাসীর কাছে গোপন করার চেষ্টা করেছিলেন ঢাকার প্রকৃত ছবিটা। কিন্তু ড্রিং সাহসিকতার সঙ্গে সেদিন তুলে ধরেছিলেন পাকিস্তানি বর্বরতার ছবি। তাঁর লেখায় উঠে আসে গণহত্যার বিবরণ।

বহু আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত ড্রিং তাঁর ব্লগে লিখেছেন সেদিনের ভয়ঙ্কর অত্যাচারের বিবরণ। গোটা শহরকে মৃত্যুনগরী বানিয়ে নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় পাক সেনা। চলতে থাকে অবাধে লুটতরাজ। বিন্দুমাত্র আপত্তি জানালেই স্থানীয়দের হত্যাই করাই ছিল পাক-সেনার একমাত্র কর্তব্য। তারা ইচ্ছা মতো বাঙালিদের খুন করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে নৃশংসতার চরম সীমায় পৌঁছায় পাকিস্তানি বর্বরতা।

এই প্রথিতযশা ব্রিটিশ সাংবাদিক মনে করেন, গণহত্যা নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ প্রায় অসম্ভব। কারণ ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোহর শহরেই ১৫ হাজারের বেশি মানুষ এক রাতে খুন হয়েছেন। তাঁর মতে, সেনা সন্ত্রাসের বহর দেখলেই কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে কতো মানুষ প্রাণ দিয়েছেন একাত্তরে পাক-হানায়। তিনি লিখেছেন, 'শিক্ষার্থীরা নিজের বিছানায় লাশ হয়ে পড়েছেন। দোকানদারদের হত্যা করা হয়েছে বাজারের মধ্যেই। নারী ও শিশুদের তাঁদের ঘরেই জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। হিন্দুদের দল বেঁধে তুলে নিয়ে গিয়ে লাইন দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তারপর পাক-সেনাই পুড়িয়ে দিয়েচে সমস্ত লাশ। ঢাকায় প্রতিটি বাড়ির ছাদে পাক-পতাকা ওড়াতে বাধ্য করেছে পাক-সেনা।'

যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ এই সাংবাদিকের লেখায় উঠে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথাও। শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি জেলে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথম সারির আওয়ামী লিগ নেতাদেরও ভরা হয় জেলে। কিন্তু তাতেও দমানো যায়নি মুক্তিযোদ্ধাদের। পাক-বাহিনীর গোলাবর্ষণের মাঝেও বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে অগণিত মানুষ মুক্তির সন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাক-সেনার হতাহতের কোনও তথ্য অবশ্য তুলে ধরতে পারেননি ড্রিং। তবে পাকিস্তানি এক সেনাকর্তা ছাড়াও দুই জওয়ানকে যে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘায়েল করতে পেরেছিলেন সেটাও তিনি উল্লেখ করেন। তাঁর স্মৃতিচারণায় স্পষ্টভাবে উঠে আসে বর্বরতার ছবি। গণমাধ্যমও সেনা হামলার হাত থেকে বাঁচেনি। দুটি সংবাদপত্র অফিস গুঁড়িয়ে দেয়। আওয়ামী লিগের বহু নেতাকে খুন করা হয়।

সাইমন ড্রিং-এর বিবরণ অনুযায়ী, পাক-সেনারা ঢাকায় সবচেয়ে বড় আঘাত হানে ছাত্রদের ওপরই। পদাতিক, সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ এই তিন পাকিস্তানি ব্যাটেলিয়ান রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়ে ঢাকা আক্রমণে। শুরু হয় গোলা বর্ষণ। নির্মম অত্যাচারে মেতে ওঠে পাক-সেনা। বঙ্গবন্ধুকে আগেই টেলিফোনে সতর্ক করা হয়েছিল। তাঁকে আত্মগোপন করার পরামর্শ দেওয়া হলেও তিনি তা করেননি। তিনি বলেছিলেন, 'আমাকে না পেলে ওরা ঢাকা শহরকে তছনছ করে ছাড়বে।'

আমেরিকা থেকে আনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত এম ২৪ ট্যাঙ্ক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাক-সেনার হামলার বিবরণও তুলে ধরেছেন ড্রিং। মাঝরাতে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরির সামনে থেকে শুরু হয় শেলিং। ইকবাল হলেই দুশোরও বেশি শিক্ষার্থী মারা যান। ছাত্রদের ওপর মেশিন গান থেকে চলতে থাকে গুলি বৃষ্টি। দুদিন পরেও লাশ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে সেখানে। গণকবর দিয়ে তারওপর চালিয়ে দেওয়া হয় ট্যাঙ্ক। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরই নয়, আশেপাশের দুশো গজ এলাকা জুড়ে চলে সেনা সন্ত্রাস। পাকিস্তানি সেনার আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায়নি মসজিদও। ঢাকা মেডিকাল কলেজেও ব্যাপক গুলি বৃষ্টি হয়। পাক-বর্বরতার প্রকৃত ছবি ঘটনার দুদিন পর বাড়ির বাইরে বার হয়ে ঢাকার মানুষ দেখতে পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরই পাক-সেনার আক্রমণের লক্ষ্য ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন। ড্রিং-এর বিবরণ অনুযায়ী প্রথমে ট্যাঙ্ক থেকে সুরু হয় শেলিং। তারপর ঘুমন্ত অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ কর্মীদের হত্যা করা হয়। ১১০০ পুলিশ কর্মী ছিলেন সেখানে। খুব কম সংখ্যরই সেদিন প্রাণ হাতে পালাতে পেরেছিলেন।

রাজারবাগে পুলিশ লাইনে হামলার সময়ই বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘিরে ফেলে পাক-সেনারা। ড্রিং লিখেছেন, রাত ১টা নাগাদই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতেও হামলা হবে। তাই একজন সহকারী আর দেহরক্ষী বাদে সকলকেই তাঁদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে ড্রিং জানতে পারেন, রাত ১টা ১০ মিনিট নাগাদ একটি ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়ি এসে থামে শেখ সাহেবের বাড়ির সামনে। শুরু হয় গোলাগুলি। তারপর এক সেনাকর্তা বাইরে থেকেই বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্যে চিৎকার করে ইংরাজিতে বলেন, 'শেখ তুমি নিচে নেমে আসো।' বঙ্গবন্ধুও তার ব্যালকনি থেকে জবাব দেন, 'হ্যাঁ, আমি আসছি। তবে গোলাগুলির কোনও প্রয়োজন নেই। তোমরা ফোন করলেই আমি চলে যেতাম।' তারপর সেই অফিসার বঙ্গবন্ধুর বাড়ির বাগানে প্রবেশ করে বলেন, 'ইউ আর অ্যারেস্টেড'। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর তিন সহকারী, দেহরক্ষী ও সহযোগীর সঙ্গে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। দেহরক্ষীকে প্রচুর মারধরও করে সেনা জওয়ানরা। বঙ্গবন্ধুকে সেনা সদরে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর চলতে থাকে ব্যাপক লুটপাঠ। সমস্ত নথিপত্র থেকে শুরু করে বহু জিনিস তছনছ করে দেয় তাঁরা। বাড়ির লাল-সবুজ পতাকা নামিয়ে ফেলা হয়।

অপারেশন সার্চ লাইটের রাতে ২টার মধ্যেই গোটা শহর জ্বলতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের খুন করেও সন্ত্রাস বন্ধ হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধারের পাশাপাশি লুকিয়ে থাকা ছাত্রদের খুন করায় কোনও খামতি ছিলো না সেনাদের। এমনটাই উঠে এসেছে ড্রিং-এর লেখায়। রাতভর নৃশসংতার পর ভোর হয়। কিন্তু ঢাকা থেকে মৃত্যু মিছিল থামবার কোনও লক্ষণ ছিলো না। দুপুরের দিকে আচমকাই সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা শুরু হয় পুরান ঢাকায়। ইংলিশ রোড, ফ্রেঞ্চ রোড, নিয়ার বাজার, সিটি বাজার প্রভৃতি এলাকায় মানুষ পালাবার পথ পাননি। দুই ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ৭০০ মানুষকে পাক-সেনারা হত্যা করে বলে লিখেছেন ড্রিং। অনেককেই জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়। পুরান ঢাকার থানাও রেহাই পায়নি। ড্রিং লিখেছেন, পুলিশ ইন্সপেক্টর জানিয়েছেন, তার সঙ্গে ২৪০ জন স্টাফ ছিলেন। কিন্তু ৩০ জনেরই শুধু সন্ধান পেয়েছেন তিনি। সেনা জওয়ানরাই পেট্রোলের ড্রাম নিয়ে ঘুরছিলেন। কোথাও কামান দিয়ে, কোথাও বা পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ঘর। রাজাকার আর আল-বদররাই চিনিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়ি। 
ঢাকায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর শিল্পাঞ্চল টঙ্গি ও নারায়ণগঞ্জ হয়ে ওঠে সেনাদের লক্ষ্য। ২৬ মার্চ রাতের মধ্যে ঢাকা শহরে সেনা আক্রমণের ঝাঁজ কমতে থাকে। কিন্তু বামপন্থী শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দেওয়ায় শিল্পাঞ্চলে শুরু হয় গুলি বর্ষণ।  ইত্তেফাক পত্রিকা অফিসে হামলা চালিয়ে সেটাকে ধংসস্তুপে পরিণত করে পাক-সেনা। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাক-নৃশংসতার বিবরণ উঠে এসেছে সাইমন ড্রিংয়ের লেখায়। একই সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন সেদিন। অসহায় মানুষদের কথাও তুলে ধরেছেন তিনি। সাইমন ড্রিং নিজেই সেই সময়ে সাহসে পর করে বিভিন্ন ধংসস্তুপ ঘুরে দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। সেটাই তুলে ধরেছেন নিজের লেখায়। তিনি নিজে কানে শুনেছেন, পাক সেনারা অখণ্ড পাকিস্তানের নামে মানুষ খুন করছে। তাদের অত্যাচারের হাত খেকে বাঁচতে বহু মানুষ বাংলাদেশ ছেড়ে নিঃস্ব অবস্থায় পালাতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ প্রাণ হাতে পালাতে পেরেছেন। কেউ পারেননি। গণহত্যার শিকার হয়েছেন তারা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে ঠাণ্ডা মাথায় কামানের গোলা দিয়ে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। পারেননি। সেনা দিয়ে নয়, মানুষের গণসমর্থনেই জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ভারত তাঁদের সেই সংগ্রামে সর্বতোভাবে সহায়তা করেছে। সঙ্গ দিয়েছে ভারতীয় সেনা ও জনগণ।

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর