বেশ কয়েক মাস ধরেই অস্থিরতা চলছে ব্রিটিশ সরকারে। প্রথমে করোনা মহামারীকালে ‘পার্টিগেট’ কেলেঙ্গারি নিয়ে তুমুল হইচই। সেযাত্রায় নিজের অনাস্থা ভোটে উতরে যান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তবে কিছু দিন পরই আবার বিপাকে পড়েন তিনি। নিজ দলের এক এমপির যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনায় যথেষ্ট দায়িত্ব আচরণ না করার অভিযোগে পদত্যাগের হিড়িক পড়ে যায় ব্রিটিশ সরকারে। অবশেষ নিজের দলীয় প্রধানের পদ ও প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন বরিস জনসন। এরপর শুরু হয় নিজ দলের নেতাদের প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য প্রতিযোগিতা। দশজনের মধ্যে এখন এই প্রতিযোগিতায় টিকে আছে দু’জন। ঋষি সুনাক ও লিজ ট্রাস।
বরিস জনসনের ক্ষমতা ছাড়ার মুহূর্ত এগিয়ে আসছে। তার উত্তরসূরি হিসেবে যুক্তরাজ্যের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন দেশটির বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস। ঋষি সুনাককে হারিয়ে ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলের প্রধান নির্বাচিত হতে পারলেই প্রধানমন্ত্রিত্ব নিশ্চিত হচ্ছে তার। সেক্ষেত্রে তিনি হবেন যুক্তরাজ্যের তৃতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী।
দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে জনপ্রিয় কট্টর রক্ষণশীল এ নেতাকে অনেকেই তুলনা দিচ্ছেন প্রথম ব্রিটিশ নারী প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে। মার্গারেট থ্যাচারের মতোই ‘লৌহমানবীর’ ভাবমূর্তিতে এরই মধ্যে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন বলে অনেকেই মনে করছেন।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এক ট্যাংকের ওপর তোলা লিজ ট্রাসের একটি ছবি কিছুদিন আগে দেশটির সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের নজর কাড়ে। স্নায়ুযুদ্ধের শেষ দিনগুলোয় মার্গারেট থ্যাচারের এমন একটি ছবি বিশ্ববাসীর সামনে তার লৌহমানবীর ইমেজকে দৃঢ় করে তুলেছিল। ছবি দুটির মধ্যকার তুলনা দিয়ে লিজ ট্রাসের সমর্থকরা বলছেন, ক্ষমতায় গেলে মার্গারেট থ্যাচারের মতোই দৃঢ় আরেকজন প্রধানমন্ত্রীকে পেতে যাচ্ছে ব্রিটেন।
কনজারভেটিভ নারী নেত্রীদের মার্গারেট থ্যাচারের আইকনিক ওই ছবির পুনর্মঞ্চায়নের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগে স্কটিশ কনজারভেটিভ রুথ ডেভিডসনসহ আরও কয়েকজন এ পথে হেঁটেছেন। তবে কেউই লিজ ট্রাসের মতো মনোযোগ কাড়তে পারেননি। এর কারণ সম্পর্কে বিশ্লেষকদের বক্তব্য হলো স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বৈরিতায় ব্রিটিশ সরকারকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মার্গারেট থ্যাচার। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও মস্কোকে মোকাবেলার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন লিজ ট্রাস। রাশিয়ার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের পক্ষেও বরাবরই কঠোর অবস্থান নিয়েছেন তিনি।
তবে দুটি প্রতিশ্রুতি তাকে রক্ষণশীলদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় করে তুলেছে। প্রথমত, করহার হ্রাসের প্রতিশ্রুতি। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়িয়ে তোলার আশ্বাস। মূলত এ দুই প্রতিশ্রুতিই তাকে দলের কট্টর ব্রেক্সিটপন্থীদের সবচেয়ে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
লিজ ট্রাসের দাবি, একমাত্র তিনিই রক্ষণশীল মূল্যবোধের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
সম্প্রতি স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ডেইলি টেলিগ্রাফে এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, এ মুহূর্তে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি অর্থনীতিতে সত্যিকারের রক্ষণশীল মূল্যবোধের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারবে। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং মুক্ত বিশ্বে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলায় নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও আমিই একমাত্র সক্ষম ব্যক্তি।
যদিও দলের মধ্যে সমালোচকদের বক্তব্য হলো লিজ ট্রাস ব্যক্তি হিসেবে অত্যন্ত গোঁড়া ধরনের। এমনকি তার মধ্যে প্রকৃত টোরি (কনজারভেটিভ সদস্যরা টোরি নামেও পরিচিত) চিন্তা-চেতনারও অভাব রয়েছে। এমনকি ইউরোপে যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক সংকট চলাকালে যুক্তরাজ্যকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো ব্যক্তিত্বেরও অভাব রয়েছে তার।
এদিকে, মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে নিজের তুলনাকে প্রত্যাখান করেছেন লিজ ট্রাস। তিনি বলেছেন, “আমি একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি। আমি আমার নিজের মতো। ”
একই সঙ্গে এ ধরনের তুলনা ‘হতাশাজনক’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
যদিও মার্গারেট থ্যাচারকেই নিজের রাজনৈতিক আইকন হিসেবে দাবি করে থাকেন লিজ ট্রাস। পোশাক-আশাকেও তার ছাপ পাওয়া যায়।
তবে তিনি বড় হয়েছিলেন অনেকটা থ্যাচারবিরোধী আবহে। মার্গারেট থ্যাচার যখন ডাউনিং স্ট্রিটে প্রবেশ করেন তখন লিজ ট্রাসের বয়স তিন। থ্যাচার প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার সময় তার বয়স ষোল। তার বাবা ছিলেন গণিতের অধ্যাপক। মা ছিলেন নার্স। দু’জনেই ছিলেন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বামপন্থী ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর থ্যাচারবিরোধী ও পরমাণুবিরোধী মিছিল-সমাবেশে নিয়মিত অংশ নিয়েছেন তারা। কখনও কখনও বাবা-মায়ের সঙ্গে লিজ ট্রাসও তাতে অংশ নিয়েছেন।
ট্রাস পড়াশোনা করেছেন উত্তর ইংল্যান্ডের লিডস শহরের একটি পাবলিক হাই স্কুলে। এরপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি। সেখানে তিনি মধ্যপন্থী লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের অবসানেরও দাবি তুলেছেন।
পড়াশোনা শেষে জ্বালানি খাতের জায়ান্ট কোম্পানি শেল ও টেলিকমিউনিকেশন ফার্ম কেবল অ্যান্ড ওয়্যারলেসে কাজ করেছেন তিনি। রক্ষণশীল দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সময়ে মধ্য ডানপন্থী একটি থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠানের হয়েও কাজ করেছেন তিনি। ২০১০ সালে প্রথম সাউথওয়েস্ট নরফোকের আইনপ্রণেতা হিসেবে নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে যোগ দেন তিনি।
২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের আলাদা হওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। যদিও তা তার বরিস জনসনের সরকারের ব্রেক্সিটপন্থী মন্ত্রিসভার অংশ হওয়ার পথে খুব একটা বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। শুরুতে বাণিজ্যমন্ত্রী ও পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কনজারভেটিভ পার্টির সবচেয়ে কট্টর অংশটির সমর্থন আদায় করে নিতে পেরেছেন তিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মহল থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন লিজ ট্রাস। ইউক্রেন যুদ্ধে তার কট্টর রুশবিরোধী অবস্থান সহযোগী পশ্চিমা দেশগুলোর প্রশংসা কুড়িয়েছে। আগের দুই পূর্বসূরি ব্যর্থ হলেও ইরানের কারাগার থেকে দুই ব্রিটিশ নাগরিককে নিরাপদে বের করে আনার বিষয়ে সফল হয়েছেন তিনি। এ বিষয়ও তার গ্রহণযোগ্যতা অনেকখানি বাড়িয়ে তুলেছে। আবার কঠোর ভাষা প্রয়োগের কারণে ইইউ ব্লকে তার বদনামও রয়েছে। সূত্র: দ্য ডিসপাচ, হ্যারো টাইমস
বিডি প্রতিদিন/কালাম