চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশ ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পরাশক্তি রাশিয়া। এরই মধ্যে এই যুদ্ধের নয় মাস পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘ এই সময়ে ইউক্রেনের বেশ কয়েক অঞ্চল দখল করে নিয়েছে রুশ সেনারা। সেগুলো থেকে কোনও কোনও পুনরুদ্ধারও করেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। ইউক্রেনকে সমঝোতায় চাপ সৃষ্টি করতে এখন দেশটির বিদ্যুৎ ব্যবস্থা মিসাইল হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। এতে দেশটির অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে।
এদিকে, যুদ্ধের এই নয় মাসে ইউক্রেনে হাজার হাজার মৃত্যু, অসংখ্য মানুষ গৃহহীন, দেশছাড়া লাখো বাসিন্দা— কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে দেশটা।
এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির স্ত্রী ওলেনা জেলেনস্কা বলেন, ‘‘অনেক কিছু সহ্য করেছে এ দেশ, আরও অনেক সহ্য করে নেবে।”
একটি ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘বিবিসি’কে সাক্ষাৎকার ওলেনা আরও বলেন, ‘‘এ যুদ্ধে জয় ছাড়া শান্তি আসবে না।”
যুদ্ধের এই নয় মাসে বারবার রণকৌশল বদল করেছে রাশিয়া। এবার তাদের অস্ত্র শীত। যেখানে তাপমাত্রা শূন্যের নীচে। বরফ পড়া শুরু হয়ে গেছে গত সপ্তাহে। এই প্রবল হিমশীতল ঠাণ্ডায় ইউক্রেনজুড়ে জমাট বেঁধেছে ঘন অন্ধকার। পাওয়ার গ্রিড লক্ষ্য করে একের পর এক রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হানায় বিদ্যুৎহীন দেশটির অধিকাংশ অঞ্চল। বিদ্যুতের অভাবে বাড়িগুলোর ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা কাজ করছে না। একাধিক কম্বলেও এ ঠাণ্ডা মানে না। পানি জমে বরফ, খাবার পানির আকাল দেখা দিয়েছে। রুশ রকেট নয়, এবারে হয়তো ঠাণ্ডাতেই আরও কত শত বাসিন্দার মৃত্যু হবে!
এই পরিস্থিতিতে ফার্স্ট লেডি ওলেনা বলেন, “শীত পড়তে শুরু করেছে। এই প্রবল ঠাণ্ডা... রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জেরে ব্ল্যাক আউট... ইউক্রেন সব সহ্য করে নেবে। আমরা লড়াই চালিয়ে যাব। এ যুদ্ধে জয় ছাড়া শান্তি আসবে না।”
রাজধানী কিয়েভে এক সরকারি ভবনে, বালির বস্তা দিয়ে ঘেরা আঁটোসাটো নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ওলেনার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ব্রিটিশ দৈনিকটির এই সাংবাদিক। মাঝে গুঞ্জন উঠেছিল, স্ত্রী-সন্তানদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। সর্বসমক্ষে সে অভিযোগ প্রত্যাখান করে দিয়েছিলেন তিনি। এই সাক্ষাৎকারও কিয়েভে বসে দিয়েছেন ওলেনা। তিনি বলেন, “কত ভয়ানক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি আমরা, কত প্রাণহানি দেখেছি, কত ধ্বংস, এই বিদ্যুৎহীন অন্ধকার পরিস্থিতিকে কখনওই সবচেয়ে কঠিন বলা যায় না।”
ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন ওলেনাও। স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন, তারা নিজেদের অবস্থান থেকে সরতে অনড়। ওলেনা বলেন, ‘‘সম্প্রতি একটি গণভোট হয়েছে। তাতে দেখা গিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার সুযোগ থাকলে মানুষ আরও দু’তিন বছর এই বিদ্যুৎ সঙ্কট সহ্য করে নিতে রাজি।”
ফার্স্ট লেডির ব্যাখ্যা, হয়তো একটা দীর্ঘ কঠিন রাস্তা, তবু তার শেষটা জানা থাকলে শান্তি। ওলেনা বলেন, “কত কিলোমিটার দৌড়াতে হবে যদি জানা থাকে, তখন ম্যারাথনও সহজ লাগে। কিন্তু এক্ষেত্রে ইউক্রেনীয়রা জানেন না, ঠিক কতটা রাস্তা তাদের দৌড়াতে হবে। তবু দৌড়ে যেতে হবে। থামলে চলবে না। মাঝে মাঝে যা অসহনীয় হয়ে উঠবে।”
ওলেনা জানালেন, শেষ কবে পরিবারের সকলে একসঙ্গে বসে খেয়েছেন, মনে নেই তার। তাদের দুই সন্তান, ১৮ বছরের ওলেকসান্দ্রা ও ৯ বছরের কিরিলো। ফার্স্ট লেডি বলেন, “আমি বাচ্চাদের নিয়ে প্রায় আলাদাই রয়েছি। উনি কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ছোট ছোট বিষয়— ঘড়ি দেখার দরকার নেই, কোনও তাড়া নেই, যতক্ষণ মন চায়, এক সঙ্গে বসে গল্প করা, সেসব আর হয় না।”
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট-পত্নী জানান, এ শুধু তাদের গল্প নয়, ইউক্রেনীয়দের জীবনই বদলে দিয়েছে এই যুদ্ধ। পরিস্থিতির চাপে রণক্ষেত্রে লড়ছেন ইঞ্জিনিয়ার থেকে ব্যালেরিনা। ৮০ লাখের কাছাকাছি মানুষ, মূলত মহিলা ও শিশু দেশছাড়া। তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যেরা দেশে রয়ে গিয়েছেন, দেশের হয়ে লড়ছেন। ওলেনা ও জেলেনস্কি স্কুলের বন্ধু, পরবর্তীকালে একজন অভিনেতা, অন্যজন চিত্রনাট্যকার ছিলেন। এখনও পাশাপাশি লড়ে চলেছেন দুই বন্ধু। সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/কালাম