সরকারি প্রকল্পের জন্য অর্থছাড় প্রক্রিয়া সহজ করা হলেও কমেনি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। বরং বেড়েছে প্রশাসনিক অস্থিরতা, দুর্নীতি আর দক্ষতার অভাব। ফলে বছরের পর বছর কেটে গেলেও বাজেট বাস্তবায়নের গতি বাড়েনি। বরং সরকারের মধ্যে দুশ্চিন্তা বেড়েছে। আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর অদক্ষতার কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন কমেছে রেকর্ড পরিমাণ। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) এডিপির মাত্র ৩৭ শতাংশের কাছাকাছি বাস্তবায়ন হয়েছে; যা গত এক দশকের সর্বনিম্ন। আগের অর্থবছর (২০২৩-২৪) একই সময়ে বাস্তবায়ন হয়েছিল ৪২ শতাংশ। অর্থ বিভাগ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অতীতে প্রায় প্রতি বছরই বাজেট বাস্তবায়নের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে তা কাটানোর নির্দেশনা দেওয়া হতো। কিন্তু সেগুলো বছরের পর বছর নিষ্ফলই থেকেছে। ফলে বাজেট বাস্তবায়নের গতি বাড়েনি এক দশকেও। যার ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে এবারও। যদিও সরকার, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটেছে। তবু কমেনি প্রশাসনিক অদক্ষতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং অনিয়ম-দুর্নীতি।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ বিভাগের তথ্যমতে, চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের নয় মাসে উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ করা ২ কোটি ২৬ লাখ ১৬৪ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৮২ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা। এ খরচের পরিমাণ মোট বরাদ্দের ৩৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। গত মার্চে খরচ হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। আগের মাসগুলোর তুলনায় মার্চে কাজের গতি কিছুটা বাড়লেও বছর শেষে মূল এডিপি কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে তা নিয়ে আশঙ্কায় অন্তর্বর্তী সরকার। যার কারণে আগামী বছরের বাজেটের আকারই কমিয়ে আনা হচ্ছে। এমনকি চলতি বাজেটের চেয়েও কম হতে পারে আগামী বাজেটের আকার। এদিকে সংশোধিত এডিপির চেয়ে প্রায় ৬০-৭০ হাজার কোটি টাকা খরচ কম হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাজেট বাস্তবায়নের বাধাগুলো তো খুবই পরিষ্কার।
এ ছাড়া এগুলো কাটানোর নির্দেশনাও দেওয়া হয় প্রতি বছর। কিন্তু প্রশাসনিক দুর্বলতা আর কাটে না। দুর্নীতিও কমে না। ফলে বাধা চিহ্নিত হলেও সে বাধা আর কাটে না।
আইএমইডির তথ্যমতে চলতি অর্থবছরের আর মাত্র তিন মাসের কম বাকি আছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে উন্নয়ন খাতে ২ লাখ ২৬ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা খরচের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে; যা মূল এডিপিতে ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি। সংশোধিত এডিপি অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে আরও ১ লাখ ৪৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে বাকি তিন মাসে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশাসনিক অদক্ষতা, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক মান উন্নয়ন করতে না পারা, উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে সমীক্ষা না করা, যোগ্যতম সরকারি কর্মচারীকে যথাযথ পদে নিয়োগ না দেওয়া, সরকারি কর্মচারীদের অদক্ষতা ও জবাবদিহির অভাব, প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি করা এবং রাজস্ব আয়ব্যয়ের সঠিক প্রাক্কলন না করা এসব কারণেই বাজেট বাস্তবায়নে গতি বাড়ানো যায় না।
অর্থ বিভাগের ১০ বছরের তথ্যানুযায়ী, প্রতিবারই বাজেট বাস্তবায়ন হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটও পুরোটা বাস্তবায়িত হয়নি। উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়ন হার ৮০ শতাংশের ঘরে থাকলেও অনুন্নয়ন বা পরিচালন বাজেটের বাস্তবায়ন হার ঠিকই ৯০ শতাংশের বেশি হয়। উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আবার তাড়াহুড়া করা হয় অর্থবছরের শেষের দিকে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮৪ দশমিক ১৬ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছিল। চলতি অর্থবছর শেষে বাস্তবায়নের হার হয়তো এর চেয়েও কম হতে পারে বলে মনে করেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।