শেরপুর জেলার সীমান্ত অঞ্চল মেঘালয়ঘেঁষা শ্রীবরদি, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী বনে মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব থামছেই না। বরাবরের মতো ধান ও ফল পাকার সময় এলেই বন্যহাতিগুলো ওসব খেতে গভীর বন থেকে লোকালয়ে আসে। আগে হাতির দল রাতে আসত, এখন দিনদুপুরেই আসছে। স্থানীয়রা ধান-ফল বাঁচাতে মরিয়া আর হাতির দল খাবারের জন্য আগ্রাসী হয়ে উঠছে। বন বিভাগ বলছে, গুল্মলতা হাতির প্রধান খাবার হলেও মিষ্টি কাঁঠাল ও পাকা ধান এই প্রাণীর একটি অতি লোভনীয় খাদ্য। যে এলাকায় এসব পাওয়া যায় হাতি শত বাধার মধ্যেও ওসবের স্বাদ নিতে আসবেই। একদিকে গভীর অরণ্য শেষ হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে হাজার হাজার গরু গুল্মলতা খেয়ে ফেলছে, নষ্ট করছে। অন্যদিকে হাতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব সীমান্তে ১৩৫ থেকে ১৪০টি হাতি আছে। হাতি আরও বাড়লে বন সংকুচিত হবে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে সামনে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব প্রকট হবে। আখেরে হাতিই পরাস্ত হয়ে বিলীন হয়ে যাবে। তিন-চার বছর আগে করা সরকারের সুফল প্রকল্পে লাগানো লতাপাতা, ফলমূলের গাছগুলো বড় হলে এ সংকট কিছুটা কমে আসবে বলে দাবি বন বিভাগের। আর হাতি ধান খেতে এলেই শত শত মানুষ হাতিকে বিরক্ত করছে, ছবি তুলছে ও বিনোদন নিচ্ছে। এতে হাতি বিরক্ত হয়ে আরও আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। এই বিনোদন বন্ধ হওয়া উচিত বলে দাবি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের। স্থানীয়রা বলছেন, ভারতের মেঘালয়ের পাহাড় ও শেরপুরের সীমান্তজুড়ে এসব হাতির আনাগোনা থাকলেও মেঘালয় সীমান্তে কাঁটাতারসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় সম্প্রতি এ হাতিগুলো ওদিকে আর যেতে পাচ্ছে না। ফলে এখানেই থেকে যাচ্ছে, বংশ বিস্তার করছে।
বন ও বনবাসী সূত্রে জানা গেছে, বছরের অন্য সময়গুলোতে মাঝে-মধ্যে হাতির দল লোকালয়ে এসে তা ব করে চলে যেত। কিন্তু ধান-ফল পাকার এ সময়ে যেতে চাচ্ছে না। এ অবস্থাটা গত কয়েক বছর ধরে বেড়ে গেছে। এনিয়ে হাতি-মানুষের বিবাদ তীব্র হচ্ছে। এ যেন দুই পক্ষের অস্তিত্বের লড়াই। এই দ্বন্দ্বে দুই পক্ষই মারা যাচ্ছে। এ সীমান্তে গত এক যুগে অন্তত দেড় শতাধিক মানুষ হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা গেছেন। এদের অধিকাংশই কৃষক। আহত হয়েছেন অনেকেই। একই সময়ে প্রাণ গেছে অর্ধশতাধিক হাতির। ক্ষতি হয়েছে ফসল আর বাড়িঘরের। দুয়ের এই দ্বন্দ্ব কমাতে সরকার কোটি টাকা ব্যয়ে পাহাড়ে বৈদ্যুতিক বেড়া (সেলার ফেনসিং) প্রকল্প চালু করে কয়েক বছর আগে। তারও আগে কাঁটাযুক্ত গাছ ও নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এই দ্বন্দ্ব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও বেড়েছে। এখন ধান কাটার মৌসুমে ফসল বাঁচাতে লাঠিসোঁঠা ও আগুনের গোলা নিয়ে রাত-দিন পাহারা বসিয়েছেন কিষান-কিষানিরা। এর মধ্যে যেকোনো সময় হাতি দলবল নিয়ে ধান খেতে নেমে পড়ছে। বাধা দিলেই শুরু হচ্ছে লড়াই। বন বিভাগ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই দ্বন্দ্ব নিরসন করতে বনে হাতির জন্য প্রাকৃতিক অভয়াশ্রমই সমাধান।
সরকারের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ বলছে, বৃহদাকার এ প্রাণীটি নিদেনপক্ষে দৈনিক ১৫০ কেজি খাবার খায়। কিন্তু মানুষের কারণে ওরা খাদ্যসংকটে পড়েছে। কমেছে হাতির বিচরণক্ষেত্র। খাদ্যসংকট ও স্বাভাবিক চলাফেরায় বিপত্তি ঘটায় মানুষের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছে হাতি। বন বিভাগের দাবি, পাহাড়ে বনাঞ্চল উজাড়, হাতির বসতি ধ্বংস, হাতির খাবারসংকট, স্বাভাবিক চলাচলে বাধা, মানুষের নিষ্ঠুরতা, হাতির বসতিতে মানববসতি গড়ে ওঠা, বনাঞ্চলের সড়ক নির্মাণ ইত্যাদি কারণে এ দ্বন্দ্ব বাড়ছে। শেরপুরের ডিএফও (জেলা বন কর্মকর্তা) বন সংরক্ষক মো. শাহিন কবির বলেছেন, মানুষ ও হাতির এই দ্বন্দ্ব অবসানে বছরখানেক আগে এ অঞ্চলে ২২ হাজার একরের অভয়াশ্রমের প্রস্তাব রয়েছে। মানুষ ও হাতিকে বাঁচাতে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে হাতির অস্তিত্ব বিনাশ হতে পারে। সর্বোপরি প্রকৃতি নষ্ট না করে বনের মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে।
জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেছেন, হাতির সঙ্গে বিনোদন বন্ধ করতে প্রশাসন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। হাতির অভয়াশ্রমের বিষয় খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। পাহাড়ের অবৈধ স্থাপনা দখলমুক্ত করতে প্রশাসন প্রতিদিনই ব্যবস্থা নিচ্ছে।