দানশীলতা মানবজীবনের একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। দানশীলতা হৃদয়ের বিশালতার অনন্য দলিল। মানব জাতির সফলতার একমাত্র ঠিকানা ইসলামের চমৎকার নির্দেশনাবলির অন্যতম এ দানশীলতা। আল্লাহতায়ালা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দয়া ও দানশীলতার অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন। কোরআন মাজিদে এ গুণের দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এটা (কোরআন) এক মহানুভব বার্তা বাহকের বাণী। এটা কোনো কবির বাণী নয়, (কিন্তু) তোমরা খুব অল্পই ইমান আনো।’ (সুরা আল হাক্কা-৪০-৪১)। উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহতায়ালা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যান্য মহান গুণের মধ্যে তাঁর মহানুভবতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। কেননা এ মহানুভবতাই অনেক গুণকে ধারণ করে রাখে। দানশীলতা, উদারতা এবং বদান্যতা সেগুলোর অন্যতম।
নবুওয়াত প্রাপ্তির আগে থেকেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দানশীলতাসহ অনন্য সব মানবিক গুণের ধারক-বাহক ছিলেন। সিরাতের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে যে, উম্মুল মুমিনীন খাদিজা (রা.) নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সান্ত¡না দিয়ে বলেছিলেন- ‘আল্লাহর কসম! কখনো না। আল্লাহ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায়-দুর্বলদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানের আপ্যায়ন করেন এবং সত্য পথের বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করেন।’ (সহিহ বুখারি-৩ সহিহ মুসলিম-১৬০)। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানশীলতা ছিল ব্যাপক ও সুবিস্তৃত। রহমতের সুশীতল বাতাসকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল তাঁর দানশীলতার ব্যাপ্তি। ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত :
তিনি বলেন, আল্লাহর রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। রমজানে তিনি আরও অধিক দানশীল হতেন, যখন জিবরাইল (আ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। আর রমজানের প্রতি রাতেই জিবরাইল (আ.) তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন এবং তাঁরা একে অপরকে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন। নিশ্চয়ই আল্লাহর রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রহমতের বায়ু অপেক্ষাও অধিক দানশীল ছিলেন। (সহিহ বুখারি-৬)।
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে যেমন দানশীলতার সর্বোচ্চ চূড়ায় উপনীত ছিলেন, তেমনি সাহাবায়ে কেরামকে দানশীলতার মতো অনন্য গুণে গুণান্বিত হওয়ার নির্দেশনা দিতেন। কারণ দানের মাধ্যমে অন্তর প্রশস্ত হয় এবং ধন-সম্পদে সমৃদ্ধি ঘটে। তাই সাহাবায়ে কেরাম ও অনাগত উম্মতকে দানশীলতার সৌরভে সুরভিত হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করে বলেন, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত : নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘প্রতিদিন সকালে দুজন ফেরেশতা অবতরণ করেন। তাঁদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! দাতাকে তার দানের উত্তম প্রতিদান দিন আর অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দিন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ১৪৪২)।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সারা জীবন যা বিশ্বাস করেছেন এবং বলেছেন, তিনি নিজে শতভাগ তার ওপর আমল করেছেন এবং তাঁর যাপিত জীবনে তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। দানশীলতাও সে সুরভিত দিকগুলোর অন্যতম। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর অনুপম আচরণমালার পরতে পরতে দানশীলতার সৌরভ ছড়িয়ে দিয়েছেন। সাহল ইবনে সাদ আস সাইদি (রা.) থেকে বর্ণিত, এক মহিলা একখানা চাদরসহ রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে এসে বলল, ইয়া রসুলুল্লাহ! আপনার জন্য আমি নিজ হাতে এটা বুনেছি। চাদরের প্রয়োজন অনুভব করে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তা গ্রহণ করলেন, অতঃপর তা লুঙ্গির মতো করে পরিধান করে আমাদের কাছে এলেন। তখন অমুকের পুত্র অমুক এসে বলল, হে রসুল! চাদরটা কী চমৎকার। এটা আমাকে পরতে দিন। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আচ্ছা। তিনি বাড়িতে গিয়ে চাদরটা ভাঁজ করে তার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। লোকজন তাকে বলল, আল্লাহর শপথ! কাজটা তুমি ভালো করোনি। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রয়োজন অনুভব করেই তা পরেছিলেন। আর তুমি তাঁর কাছে তা চেয়ে নিলে! অথচ তুমি জান যে তিনি কোনো প্রার্থীকেই বিমুখ করেন না। সে বলল, আল্লাহর শপথ! আমি এটা পরার জন্য তাঁর কাছ থেকে চেয়ে নিইনি, বরং আমার কাফন বানানোর জন্য চেয়ে নিয়েছি। সাহল (রা.) বলেন, লোকটা যেদিন মারা গেল সেদিন সেটিই তার কাফন হলো। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নম্বর ৩৫৫৫)। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত সুবিশাল হৃদয়ের ধারক ছিলেন যে, কখনো কেউ তাঁর কাছে কিছু চাইলে কখনো ‘না’ করতেন না। হজরত জাবের (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এমন কোনো জিনিস চাওয়া হয়নি, যার উত্তরে তিনি ‘না’ বলেছেন। (সহিহ মুসলিম-২৩১১)। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুপম অভ্যাস এমন ছিল যে, কারও চাওয়ার আগেই তিনি তাকে দান করে দিতেন।
লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর
বিডি প্রতিদিন/এমআই