পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে মহান আল্লাহ দুনিয়ার ভালোবাসায় মত্ত থাকার এবং পরকালকে ভুলে যাওয়ার নিন্দা করেছেন। দুনিয়ার ভালোবাসায় মত্ত থাকার অর্থ হলো দ্বিনদারির ওপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দেওয়া এবং আখিরাতের চিন্তা ত্যাগ করা। দুনিয়ার প্রতি আসক্ত ব্যক্তিরা পার্থিব জীবনের অর্জনকেই কেবল সাফল্য মনে করে। দুনিয়ার ভালোবাসায় মত্ত হয়ে থাকা এবং পরকাল থেকে বিমুখ হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো আলেমদের সান্নিধ্যে না থাকা।
আলেমদের সান্নিধ্য মানুষকে নানাভাবে আল্লাহমুখী করে। যেমন—দ্বিনি জ্ঞান লাভ, আল্লাহর ভালোবাসার প্রতি আগ্রহ তৈরি, দুনিয়াবিমুখ জীবনের রূপরেখা সম্পর্কে অবগত হওয়া ইত্যাদি।
সাধারণ মানুষের উচিত আলেমদের সান্নিধ্য লাভের জন্য কিছু সময় বের করে নেওয়া; অন্তত ৪০ দিনের জন্য হলেও। দুঃখের বিষয় হলো মানুষ দৈহিক রোগের জন্য চাকরি থেকে ছুটি নেওয়া, অর্থ ব্যয় করা, প্রয়োজনে চাকরি ত্যাগ করার মতো পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করে না।
কিন্তু আত্মিক ও আধ্যাত্মিক চিকিৎসা নিয়ে মানুষের কোনো ভাবান্তর নেই। আমি অত্যন্ত আশার সঙ্গে বলতে পারি, কেউ যদি আল্লাহপ্রেমী ও বিশুদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী আলেমদের কাছে অন্তত ৪০ দিন অবস্থান করে আত্মার রোগের চিকিৎসা করে তাহলে তার সব সংশয় ও প্রশ্নের অবসান হবে।
মানুষের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় চাহিদা ও প্রয়োজনের আলোকে। যেহেতু মানুষের মনে দৈহিক রোগ থেকে আরোগ্য লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকে, তাই মানুষ এর জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু করে, সম্ভাব্য সব ক্ষতিও মেনে নেয়।
অন্যদিকে আত্মিক রোগের ব্যাপারে তারা হয় সম্পূর্ণ উদাসীন। কেননা এই রোগ থেকে মুক্তির ব্যাপারে তাদের কোনো চিন্তা নেই। যদি দৈহিক রোগের মতো আত্মিক রোগ থেকে মুক্তির জন্য মানুষ চেষ্টা করত, তাহলে কতই না উত্তম হতো! একজন আধ্যাত্মিক চিকিৎসকের কাছে ৪০ দিন অবস্থান করা কি খুব কঠিন কিছু? চেষ্টা করুন এই সময়টুকু বের করার। এরপর দ্বিন ও ইসলামের আলোচনা ও সমালোচনার প্রয়োজন হবে না। কোনো একজন কবি বলেন, ‘কামেল পীরের সাক্ষাৎ সব প্রশ্নের উত্তর।
বিনা বাক্য ব্যয়ে তোমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।’
কারো বিশ্বাস না হলে বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রহ.) বলেন, ‘সূর্যের প্রমাণ সূর্য নিজেই। এর পরও যদি তোমার প্রমাণের প্রয়োজন হয়, তাহলে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।’
আমি আলেমদের সান্নিধ্যে ৪০ দিন থাকার যে কথা বলছি তা হাদিসের মর্মানুসারেই বলেছি। তাহলো যে ব্যক্তি খাঁটি নিয়তে ৪০ দিন নিজেকে আল্লাহর কাজে উৎসর্গ করে, আল্লাহ তার অন্তর থেকে হিকমত বা প্রজ্ঞার নহর জারি করে দেন।
মনে রাখতে হবে, কোনো জাগতিক উদ্দেশে আলেম বা পীরের সান্নিধ্যে থাকলে তাতে পরকালের কোনো উপকার হবে না। কোনো এক গ্রাম্য লোককে একজন আলেম বলেছিলেন, তুমি একাধারে ৪০ দিন নামাজ পড়লে আমি তোমাকে একটি মহিষ দেব। সে বলল, খুব ভালো। ৪০ দিন পর গ্রাম্য লোকটি এসে আলেমকে বলল, আমি একাধারে ৪০ দিন নামাজ পড়েছি, আমাকে মহিষ দিন। তখন আলেম ব্যক্তি বললেন, আমি তোমাকে মহিষ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলাম এ জন্য যে নামাজ পড়তে পড়তে তুমি নামাজে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। এরপর তুমি আর কখনো নামাজ ত্যাগ করবে না। সে বলল, আচ্ছা, তুমি তাহলে আমাকে ধোঁকা দিয়েছ? তবে যাও, আমিও অজু ছাড়াই ঢু মেরেছি, তোমাকে ফাঁকি দিয়েছি।
মোটকথা, আলেমদের কাছে রুটি খাওয়ার নিয়তে থাকবে না, বরং রুটি নিজ উপার্জন থেকে খাবে। এতে আলেমদের কাছে থাকার কিছুটা হলেও মূল্য হবে। দ্বিনের অর্থ ব্যয় করার বিশেষ উপকার ও কল্যাণ আছে। একবার আমার পীর ও মুরশিদের নির্দেশে সর্বসাধারণের কল্যাণের কথা চিন্তা করে আমি একটি পুস্তিকা প্রকাশ করি। আমার ইচ্ছা ছিল আমি তা বিনা মূল্যে বিতরণ করব। কিন্তু তিনি আমাকে বললেন, বিনা মূল্যে নয়, কিছু মূল্য নিয়ে তা বিতরণ করো। কেননা বিনা মূল্যের কোনো কিছুর মূল্যায়ন থাকে না।
আলেমদের সান্নিধ্যে যাওয়ার আগে নিয়ত শুদ্ধ করে, সরল বিশ্বাস নিয়ে এবং বাজে ঝামেলা মুক্ত হয়ে যাওয়া আবশ্যক। যে কোনো নেক কাজ এভাবেই করা উচিত। এতে কিছুটা হলেও সুফল পাওয়ার আশা করা যায়। একবার মুজাফফরনগরের একজন তহশিলদার এক ব্যক্তিকে আমার কাছে নিয়ে এসে বললেন, এই ব্যক্তির মনে ধর্মীয় ব্যাপারে জটিল সংশয় আছে। আপনি তাকে কিছু বুঝিয়ে দিলে খুব উপকার হতো, এই ব্যক্তি তার মনে শান্তি পেত। আমি বললাম, সে আমার সঙ্গে আসুক। আমার ওখানে কিছুদিন থাকলে তার সংশয় নিজ থেকেই দূর হয়ে যাবে। সুতরাং অন্তত ৪০ দিনের জন্য হলেও অন্তরের বোতলে আল্লাহপ্রেমের শরাব ভরে নাও। তোমার অন্তরে শান্তি আসবে। বড় বড় পীর ও ওলিদের কাছে যাওয়ার সাহস না হলে স্থানীয় আলেমদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে, তাদের সান্নিধ্যে থাকার চেষ্টা করবে। এতে অন্তরের সব সংশয়-সন্দেহ দূর হবে, আল্লাহর ভালোবাসা ও মহব্বত বৃদ্ধি পাবে, নেক আমলের আগ্রহ তৈরি হবে এবং সর্বোপরি আল্লাহর নৈকট্য নসিব হবে।
অনেকের মনে ভয় কাজ করে, আলেমদের পরামর্শে চললে তারা আমাদের দুনিয়ায় উপার্জন করতে দেবে না। এতে পার্থিব জীবন অচল হয়ে যাবে এবং ঘরসংসার ধ্বংস হবে। তাদের ধারণা অমূলক। আলেমরা দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করতে বলেন, তাঁরা পার্থিব জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় উপার্জন ত্যাগ করতে বলেন না। তাঁরা দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করতে বলেন, কেননা হাদিসে দুনিয়ার ভালোবাসা ও মোহকে সব পাপের মাথা বা মূল বলা হয়েছে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে দ্বিনের সঠিক জ্ঞান, বুঝ ও আমল দান করুন। আমিন।
ভাষান্তর : মাওয়ায়েজে আশরাফিয়া থেকে
মো. আবদুল মজিদ মোল্লা